Saturday, 26 December 2015

Tourism in Chittagong , Bangladesh

পুলিশের নিষেধ এড়িয়ে তৈদুছড়ার পথে

ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:26 Dec 2015   04:46:04 PM   Saturday   
পুলিশের নিষেধ এড়িয়ে তৈদুছড়ার পথে
ফেরদৌস জামান : চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি এলাকায় চা বাগান ভ্রমণ শেষে হাতে দু-এক দিন সময় রয়ে গেছে। কোথায় যাওয়া যেতে পারে? এমন ভাবনা করতে করতে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছি। খেয়াল করলাম বেশ কয়েকজনের এক এ্যাডভেঞ্চার গ্রুপ উদ্বিগ্ন মেজাজে বিকল্প কোনো ব্যবস্থার বিষয়ে আলোচনারত। পাশেই তাদের নষ্ট বাসের মেরামত চলছে। সময় অনেক অতিবাহিত হয়ে গেছে, তারা আর দেরি করতে রাজি নয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, তৈদুছড়া নামক অতি সুন্দর এক ঝরনা দেখতে তারা ঢাকা থেকে রওনা করেছে। আলাপের এক পর্যায়ে তারা আমাদের পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার পর সহ-অভিযাত্রী করে নিতে সম্মত হলো। এরই মধ্যে বাসের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। সুতরাং রওনা হলাম তাদের সঙ্গে। খাগড়াছড়ি গিয়ে সরাসরি উঠে পরলাম চান্দের গাড়িতে। আমরা দুজন যোগ হওয়ায় দলে সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল এগারোতে।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর, শেষ বর্ষায় মেতেছে সারা দেশ। সর্বপ্রথম এক হোটেলে উঠে ব্যাকপ্যাক রেখেই বের হই তৈদুছড়া অভিযানের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত ও নির্ভরযোগ্য একজন গাইডের খোঁজে। এগারো সদস্যের বড় দল দেখে আশপাশে যেন শোরগোল পড়ে গেল। যে কারণে অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য ও আতঙ্কজনক আজগুবি সব মন্তব্য মুনতে পেলাম। আর তাতেই দলের দু-এক জনের মধ্যে রীতিমত ভীতির সঞ্চার হলো। সর্বসাকুল্যে হোটেল রুমের মাঝরাতের মিটিং-এ অভিযান বাতিল বলে সাব্যস্ত হলো। ঠিক পরদিন সকালের গাড়িতে সোজা খাগড়াছড়ি চলে গেলাম। কারণ শহরের আশপাশ ঘুরে দেখার বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। বর্ষা চলমান, পাহাড়ের গায়ে মেঘের আনাগোনা। উপভোগ করতে হলে গাড়ির ছাদ উৎকৃষ্ট জায়গা। সুতরাং একে একে সকলেই ছাদে উঠে পরি। বৃষ্টি ভেজা হয়ে শহরে চলে আসি। শহর ও তার আশপাশটা দেখার পর এবার বিদায়ের পালা। তারা যাবে চট্টগ্রাম, আর আমরা দুজন সকালে শহরে ফেরত আসব এই সিদ্ধান্ত আগেই হয়ে আছে। তাদের বিদায় দিয়ে পুনরায় ফিরে আসব দিঘীনালা। কারণ শেষ চেষ্টা করেই ছাড়ব। খানিকটা আবেগঘন এক বিদায়ের পর দিনের শেষ গাড়িতে দিঘীনালা গিয়ে উপস্থিত হলাম।


তৈদুছড়া যাওয়ার পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য সরাসরি চলে গেলাম থানায়। ডিউটি অফিসার সম্মতি জ্ঞাপন করলেও ওসি সাহেব রাজি হলেন না। পার্বত্য জেলাগুলোর মধ্যে একমাত্র বান্দরবান ছাড়া অন্য দুটির স্থানীয় রাজনীতি তুলনামূলক অধিক অস্থিতিশীল। তার মধ্যে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা ও আশপাশের পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ বলা যেতে পারে। অপহরনের মত ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। সুতরাং একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে সে দায় কে নেবে? এমন আশংকায় তিনি বরং আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাতেও দমে না গিয়ে রাত পেরিয়ে সকাল থেকে নিজেরাই প্রচেষ্টা চালালাম। যেহেতু রাজনৈতিক সমস্যা, সেহেতু রাজনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই একটা উপায় বের করতে সচেষ্ট হলাম। ওদিকে থানার অসম্মতি রয়েছে, তাই সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। নয়তো বেঁধে যেতে পারে আর এক গোলমাল।


১৯ সেপ্টেম্বর, ভোরের আলো ছড়ানোর আগেই কাপড়চোপড় পরে প্রস্তুত হয়ে একটা ফোনের অপেক্ষায় থাকলাম। অবশেষে ফোন এলে পৌঁছে যাই নির্দিষ্ট লোকেশনে। অটোরিকশা নিয়ে প্রস্তুত ছিল দুইজন। উপস্থিত হওয়া মাত্রই আমাদের উঠতে বলা হলো। আমরা উঠে বসলাম। উঁচুনিচু পথে একটানে শাপ্পাপাড়া নামক এক বসতিতে চলে এলাম। মূলত সেখান থেকেই ট্রেকিং শুরু। বাঙালিরা সাধারণত ওদিকে যায় না। এমনকি পুলিশও যায় না। স্থানীয়রা আমদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আকাশ পরিস্কার, রোদ উঠেছে বেশ। পাহাড় ট্রেকিংয়ের এক পর্যায়ে ত্রিপুরাদের পাড়া। পাশ দিয়ে নেমে এসেছে সরু খাল বা ছড়া। ছড়ার নামা অনুসারেই পাড়ার নাম তৈদুপাড়া। ছড়ার উজানে যেতে হলো, মানুষ মাত্র চারজন। ক্রমেই প্রবেশ করলাম গভীর অরণ্যে। দুপাশের পাহাড় থেকে ঝুলে নেমেছে ডাল ও লতাপাতা আর ছড়ার মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথর। পিচ্ছিল পাথরে পা রেখে এগিয়ে চলা ঝুকিপূর্ণ। বুক পানি, কোমর পানি পথে এগিয়ে যেতে যেতে একবার ভুল-ও হয়ে গেল। অবশেষে দুপুর একটা নাগাদ চোখে পড়ল তৈদুছড়া।


প্রায় ৪০ ফুট ওপর থেকে নেমে আসছে জলের ধারা। সে শব্দ অবশ্য অনেক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। জানতে পারলাম ওপরে ঝরনার আরও একটা স্টেপ রয়েছে। সেটা আবার বাদ যাবে কেনো? অপেক্ষা না করে পাশের দেয়াল ধরে উঠে যাই ওপরে। প্রতিকূলে মাত্র এক ঘণ্টার ট্রেকিং, সারাটা পথই ঢালু ও পিচ্ছিল, মাঝে রয়েছে এক ফাটল। প্রচণ্ড গতিতে পানি গড়িয়ে পরছে। দুই আড়াই ফুট চওড়া ফাটলের মাঝ দিয়ে পানি যেন ঠেলে নামছে। লতা এবং দুপাশের দেয়ালে হালকা খাঁজ না থাকলে পাড়ি দেয়া বোধহয় দুস্কর হয়ে পড়ত। গাছপালা আর পাথরের বোল্ডারের ফাঁক দিয়ে ঝরনাটা দেখা যায় অনেক দূর থেকে। সম্প্রতি জানা গেছে তৈদুছড়ার দ্বিতীয় স্টেপের ওপর নাকি আরও একটা স্টেপ আছে।


এত প্রতিবন্ধকতা হার মানিয়ে তৈদুছড়ায় পৌঁছতে পেরে আমাদের মনে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। ইচ্ছা যদি আন্তরিক হয়ে থাকে তবে অসম্ভবকে সম্ভব করা আসলে দুঃসাধ্য নয়-আমরা নিজেদের গৌরবে নিজেরাই অভিভূত হলাম। পরক্ষণেই আবেগ সামলে নিলাম। কারণ থানার কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু সেটাও ওই অল্প সময়ের জন্য। আমরা লাফিয়ে নামলাম ঝরনার পানিতে। তৈদুছড়ার জলে একাকার হয়ে গেলাম! কেবল খারাপ লাগল ফিরে যাওয়া বন্ধুদের কথা ভেবে। ঢাকায় ফিরে অবশ্য তাদের সাথে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছি। বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল নিজস্ব স্বতন্ত্রে সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। কত কিছু যে এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে! কিছু মানুষ আছে যাদের কাজই হলো নতুন জায়গা খুঁজে বের করা। যার ফলে আমরা সাধারণ মানুষ প্রকৃতির অকৃত্রিমতার কিছুটা স্বাদ গ্রহণ করতে পারি। অধিকন্তু লেখার মধ্য দিয়ে সেই সমস্ত অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কিছুটা আওড়ানোর সুযোগ পাই। প্রত্যেকটা ঝরনার রয়েছে আলাদা রূপ ও আলাদা বৈশিষ্ট্য। সম্ভব হলে আগামীতে আরও কিছু ঝরনার রূপ ও অভিযানের কথা তুলে ধরব। যাই হোক, নিচে নেমে এসে প্রথম স্টেপেও চললো খানিক লাফালাফি। অতঃপর খাবার গ্রহণের পর্ব। ট্রেইলে পাওয়া গিয়েছিল বাঙ্গি জাতীয় ফল এবং আধপাকা ডুমুর। সঙ্গী দুজন আমাদের আপ্যায়নের জন্য কেক ও অ্যানার্জি ড্রিংক নিয়ে গিয়েছিলেন। সব শেষে তৈদুছড়াকে বিদায় জানিয়ে পা বাড়ালাম ফিরতি পথে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ডিসেম্বর ২০১৫/তারা

No comments:

Post a Comment