Sunday, 27 December 2015

Education sector info 2015

নানা ঘটনায় ভরা শিক্ষাখাত

নাসির উদ্দিন চৌধুরী : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:25 Dec 2015   03:09:47 PM   Friday   ||   Updated:27 Dec 2015   01:21:15 PM   Sunday
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

নাসির উদ্দিন চৌধুরী : অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষাখাতেও ২০১৫ সাল ছিল নানা ঘটনায় ভরা। এরমধ্যে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে উত্তাল রাজপথ এবং সর্বশেষ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

এছাড়া কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যবস্থা চালু এবং এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গভর্নিং বডির ক্ষমতা হরণ, এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকদের আমরণ অনশন, পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরণের সর্ম্পক ছিন্ন করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দাবি, প্রথমবারের মতো গ্রেডিং সিস্টেমে অনার্সের ফলাফল ঘোষণা ছিল আলোচিত ঘটনা। তবে শিক্ষকদের আন্দোলনের ঘটনায় প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং লেখক ড. জাফর ইকবালের উপর হামলা শিক্ষাক্ষেত্রে ২০১৫ সালের সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট আরোপ নিয়ে অরাজনৈতিক আন্দোলন : চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। প্রথম থেকেই বিষয়টির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা।

ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের হামলা হয়। এরপর কার্যত অবরোধ সৃষ্টি হয় রাজধানীতে। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এই আন্দোলনে গণমানুষেরও সমর্থন ছিল। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও।

কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ভ্যাট প্রত্যাহার হবে না বলে ঘোষণা দেন। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরো জোরালো হয়। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিজয় হয়। অর্থমন্ত্রী ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

অনলাইনে ভর্তি নিয়ে সমস্যা : বছরের মাঝামাঝি সময়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি নিয়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি দিতে এবার অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করে ফলাফলের ভিত্তিতে কলেজগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ইতিবাচক এই উদ্যোগটি শুরুতেই হোঁচট খায়। পদ্ধতিটি একেবারেই নতুন কিংবা আনকোরা নয়। এই পদ্ধতিতে ভর্তির উদ্যোগ এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরীক্ষিত এই পদ্ধতিটি কলেজ পর্যায়ে শুরুতেই হোঁচট খাবে- এমন ভাবনা কেউ করেননি। কিন্তু তাই ঘটেছে। তিন দিনেও অনলাইনে ভর্তির তালিকা প্রকাশ করার মতো কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি।

এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, সার্ভারের ধারণ ক্ষমতার অভাব, বিপুল ডাটা হ্যান্ডেলিংয়ে অনভিজ্ঞতা, বুয়েট ও ঢাকা বোর্ডের কাজে সমন্বয়হীনতা, বেসরকারি যে কোম্পানিটি কাজ পায়নি তাদের কয়েক দফা সাইট হ্যাক করা প্রভৃতি। উপযুক্ত সব কারণই হয়তো দায়ী এই অনভিপ্রেত বিড়ম্বনার জন্য।

এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তও দায়ী বলে মনে করেন অনেকে। কারণ, প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল যেসব কলেজের আসন সংখ্যা ৩০০-এর উপরে তারাই শুধু অনলাইন আবেদনের অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের একক সিদ্ধান্তে, একেবারে শেষ মুহূর্তে সব কলেজকেই অনলাইন ভর্তির আওতাভুক্ত করা হয়। সারা দেশের প্রায় তিন হাজার ৭৫৭টি কলেজকে অনলাইনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যও বোর্ডের হাতে নেই। ফলে এই হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসে।

জেলা পর্যায়ে সরকারি স্কুলে অনলাইনে ভর্তি : চলতি বছর থেকে সারাদেশের সকল সরকারি স্কুলে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন এক মাইলফলক অর্জন করে বাংলাদেশ। গত বছর রাজধানীর ৩৫টি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। এবার ঢাকা মহানগরীসহ (চট্টগ্রাম ছাড়া) সকল বিভাগীয় ও জেলা সদরের সরকারি স্কুলে সকল শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই প্রক্রিয়া অনেকের কাছে সাধুবাদ পেয়েছে। আশা করা হচ্ছে আগামীতেও এই পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে।

শাবিপ্রবিতে জাফর ইকবালের উপর  হামলা : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর হামলা চালানো হয়েছে। দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ-লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হকসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে এ সময় জখম ও লাঞ্ছিত করা হয়।

৩০ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টায় উপাচার্য অধ্যাপক আমিনুল হক ভূঁইয়া প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের নিয়ে জরুরি কাউন্সিল করতে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার সময় শিক্ষকরা বাধা দিলে এই হামলা চালানো হয়।

আন্দোলনকারী যেসব শিক্ষক হামলার শিকার তাদের মধ্যে আছেন ড. জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হক, ড. ইউনুছ, দীপেন দেবনাথ, আন্দোলনের মুখপাত্র সৈয়দ সামসুল আলম, ফারুক উদ্দিন, মোস্তফা কামাল মাসুদ, মোহাম্মদ ওমর ফারুক। লাঞ্ছিত শিক্ষকদের অভিযোগ ছিল, হামলাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

এ ঘঠনায় পুরো দেশে নিন্দায় ঝড় উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের স্বচ্ছতা নিয়েও কথা তোলেন অনেকে। পরে এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

গভর্নিংবডির শিক্ষক নিয়োগ ক্ষমতা বাতিল : বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগ আরো স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে এ বছর। সংস্কার করা হয়েছে এ সংক্রান্ত বিধিমালা। পরিবর্তন আসে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও। এজন্য বর্তমান বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ`কে (এনটিআরসিএ) পুনর্বিন্যাস করে আলাদা কমিশন গঠন করে পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগে গভর্নিংবডির আর কোনো ক্ষমতা থাকছে না। তাদের দায়িত্ব থাকবে শুধু শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা এবং শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা। যদিও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ কথার সঙ্গে দ্বিমত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগে নানারকম অনিয়ম চলে। নিয়োগকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেনদেনের অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে আসে। ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি সমাজে ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বার্থে শিক্ষাকে এ ব্যধি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এজন্য বিদ্যমান শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যেখানে লেনদেনের সুযোগ কম থাকবে।’

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় মেধাতালিকার কোনো সুযোগ নেই। নিবন্ধন পরীক্ষায় পদের চেয়েও বেশি পাস করানো হচ্ছে। এতে প্রতিযোগিতা বেশি হচ্ছে পাশাপাশি অনিয়মও বেশি হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। প্রায়ই এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ আসে। দেখা যায়, একটি পদের বিপরীতে প্রায় ২০ জন প্রার্থী পরীক্ষা দেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা সবার কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করেন। কিন্তু নিয়োগ পায় একজন। সংশ্লিষ্টরা প্রভাবশালী হওয়ায় বাকিদের টাকাও ফেরত দেওয়া হয় না। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সর্ম্পক ছিন্ন : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা চালানোর কথা অস্বীকার করায় পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সিন্ডিকেট।

সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ মস আরেফিন সিদ্দিক জানিয়েছেন, ৭১ সালে পাকিস্তান এদেশের যে গণহত্যা চালিয়েছে তা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কীভাবে সেটা অস্বীকার করছে তা আমাদের বোধগাম্য নয়। ৩০ লাখ লোক হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দেশ পাকিস্তান। কিন্তু যখন তারা বলে, গণহত্যার সাথে জড়িত নয় তারা। তখন আমরা মনে করি, তারা আবার দ্বিতীয়বার গণহত্যা চালাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখা হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং বিশেষ সিন্ডিকেটের সভার মাধ্যমে এটা কার্যকর করা হলো। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র-শিক্ষক পাকিস্তানে যাবে না। তারা এলেও আমরা গ্রহণ করবো না। তবে যারা অধ্যয়নরত তারা থাকবে। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।’






রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ডিসেম্বর ২০১৫/নাসির/শাহনেওয়াজ

No comments:

Post a Comment