বয়স যাদের বাধা হয়নি
মুম রহমান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:23 Dec 2015 12:10:28 AM Wednesday || Updated:23 Dec 2015 10:58:41 AM Wednesday

আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়েননি এমন শিক্ষিত লোক দুনিয়ায় কমই আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান এই বালিকা যুদ্ধের ডামাডোলে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। বাঙ্কারে লুকিয়ে লুকিয়ে জীবন কাটাতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পাননি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মৃত এই কিশোরী অমর হয়ে আছে একটি ডায়েরি লিখে। ১৫ বছরে আমরা বাঁচতেই শিখি না, জীবন কি জানি না, অথচ ছোট্ট আনা জীবন জয় করে গেলেন তার বিস্ময়কর ও সৎ লেখনি দিয়েই।
মিশরের রাজাদের বলা হতো ফারাও। বিশ্বাস করা হতো ফারাওরা ঈশ্বরের মতোই ক্ষমতাধর!
মিশরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফারাও হলেন তুতেনখামেন। মাত্র নয় বছর রাজত্ব করেছিলেন তিনি আর বেঁচে ছিলেন ১৮ বছর। স্বল্প আয়ু আর স্বল্প রাজত্বকাল দিয়েই তিনি বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। রোম যখন পুড়ছে নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন- এ কথা কে না শুনেছে? ক্ষমতাধর রোমান শাসক নিরো মারা যান ৩১ বছরে, কিন্তু ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে তার কাজ দিয়েই।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ ও তার বেঈমান দোসরদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত ও নিহত হন বাংলার স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজদ্দৌলা।
আজও তাকে বাংলার মানুষ স্বাধীনচেতা এবং ইংরেজবিরোধী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সম্মানের আসনে রেখেছে। ফরাসী বিপ্লবী নারী জোয়ান অব আর্ককে ‘ডাইনি’ বলে পুড়িয়ে মারা হয়। তখন তার বয়স ছিলো ১৯ বছর। ১৯ বছরের এই তরুণী দেশ স্বাধীন করার জন্য পুরুষ সেজে ঘোড়ায় চড়ে তরবারি হাতে যুদ্ধ করেছেন। তার যুদ্ধ কৌশল ও বীরত্বের কাছে একাধিকবার পরাজিত হয়েই তাকে যাদুকর, ডাইনি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়।
মাত্র ২৫ বছরে মারা গেছেন বাংলার জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ। এই অল্প সময়েই তিনি প্রায় ৩০টি চলচ্চিত্র ও ১০টি টিভি নাটকে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। হলিউডের সবুজ নায়ক জেমস ডিন এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান ২৪ বছর বয়সে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই তিনি মার্কিন টিনএজ জেনারেশনের আইকন হয়ে ওঠেন। আমেরিকান ফিল্ম একাডেমি তাকে বিশ্বের সেরা ২০ অভিনেতার মধ্যে ঠাঁই দিয়েছে। মৃত্যুর পরও তিনি অস্কারে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছেন।
বলা হয়ে থাকে, কবিরা চিরতরুণ, তাদের বয়স হয় না। ইংরেজ কবি জন কীটস মারা গেছেন ২৫ বছর বয়সে; পার্সি বিসি শেলি ২৯ বছরে; অতদূরের কথা বাদ দিন, বাংলার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মারা গেছেন ২১ বছরে। শেলি এবং কীটসকে যেমন ইংরেজি কবিতার দুই দিকপাল ধরা হয়, তেমনি কাব্যে আমাদের প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা সুকান্তের কবিতা। এদের কারো কাব্য প্রতিভা, ভাষা শক্তি বয়সের কাছে হার মানেনি। ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়রের পরেই সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি ও নাট্যকার হিসাবে ক্রিস্টোফার মার্লো স্বীকৃত। ইলিজাবেথিয়ান যুগের এই কবি ও নাট্যকার ২৯ বছরে নিহত হন আততায়ী হাতে। কিন্তু তার লেখা তৈমুর লঙ, ডক্টর ফস্টাস নাটক আজও বিশ্বের প্রতিটি দেশে পাঠ্য। আরেক ইংরেজ কবি টমাস চেটার্টন মারা গেছেন ১৭ বছর বয়সে। অসাধারণ প্রতিভাধর মার্কিন মহিলা কবি সিলভিয়া প্লাথ মাত্র ২১ বছর বয়সে আত্মহনন করেছিলেন। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন এরিয়েল-এর মতো অসামান্য কাব্যগ্রন্থর জন্য।
অল্প বয়স বলে আমরা কাজকে অনেক সময় গুরুত্ব দেই না, আবার বয়স হয়েছে বলে অনেক কাজ থেকেই ছুটি নেই। বিশ্বব্যাপী এমন অনেক বয়স্ক ব্যক্তি আছেন যারা বয়সকে হার মানিয়েছেন কাজ দিয়ে। কর্মে অবিচল থেকে জীবনকে কাজে লাগিয়েছেন বহু মনীষী। ৮০ বৎসর বয়সে জর্জ বানর্স ‘দ্য সানসাইন বয়েজ’-এ অভিনয় করে অস্কার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। ৮১ বৎসর বয়সে এসে গ্যাটে তার শ্রেষ্ঠ কর্ম ‘ফাউস্ট’ রচনা শেষ করেন। ৮২ বৎসর বয়সে উইনস্টন চার্চিল ‘আ হিস্টরি অব ইংলিশ স্পিকিং পিপলস’ লেখেন। ৮২ বৎসর বয়সে টলস্টয় তার ‘আই ক্যান নট বি সায়লেন্ট’ লিখেছিলেন, সমারসেট মম ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ লিখেছিলেন ৮৪ বৎসর বয়সে এসে। বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন আইকন কোকো শ্যানেল ৮৫ বৎসর বয়সে তার ফ্যাশান ডিজাইন ফার্মের প্রধান হন।
চিত্রশিল্পী ভাস্কর মাইকেল এঞ্জেলো ৮৮ বৎসর বয়সে সান্তা মারিয়া চার্চের নকশা করেন। ৯০ বছর বয়সেও বিশ্বসেরা চিত্রকর পিকাসো তার ড্রয়িং ও এনগ্রেভিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি নতুন প্রযুক্তিতে আলো দিয়ে ছবি এঁকেছেন তিনি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে। এমানন দু ভেলেরা ৯১ বছর বয়সে আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হন। রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়িত্বে বয়স কোনো বাধা হয়নি। ৯৩ বছর বয়সে জর্জ বার্নাড শ ‘ফারফিচেড ফেবল’ নাটকটি লেখেন। পৃথিবীর অন্যতম বয়স্ক নারী গ্রান্ডমা মোসেজ ১০০ বছর বয়সেও ছবি আঁকা অব্যাহত রাখেন। এভারেস্ট বিশ্বের অন্যতম দূর্গম স্থান আর সবচেয়ে উঁচু জায়গা। আমেরিকার ১৩ বছরের বালক জর্ডান রোমেরো মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করেন। ১৫ বছর বয়সে এসে সে পৃথিবীর সাতটি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয়ের রেকর্ড করেন।
অন্যদিকে জাপানের ইউচিরো মিউরা ৮০ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেন। আমরা যারা কম বয়স, আর বেশি বয়স বা কোনটা কোন কাজের সঠিক বয়স তাই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছি তারা হয়তো জানিও না বয়স বলে আসলে কিছু নেই। ১৩ থেকে ৮০ যে কোনো বয়সে এভারেস্টও জয় করা যায়। আসলে যে কোনো সময়, যে কোনো কিছু করা যায় যদি ইচ্ছাশক্তি থাকে- অন্তত ইতিহাস তাই বলে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ডিসেম্বর ২০১৫/তারা
No comments:
Post a Comment