Thursday, 31 March 2016

Tourism in Tista river and Trivane

তিস্তাগাঁয়ের ত্রিভেনী

ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:30 Mar 2016   09:04:30 PM   Wednesday   ||   Updated:30 Mar 2016   09:08:58 PM   Wednesday
উঁচু থেকে তিস্তা নদী

উঁচু থেকে তিস্তা নদী

ফেরদৌস জামান : বাংলাদেশের প্রধান নদীর মধ্যে তিস্তা অন্যতম। বয়ে এসেছে সেই তিব্বত হয়ে ইন্ডিয়ার মাঝদিয়ে। দীর্ঘপথ পরিক্রমায় একই নামে প্রবাহিত হয়ে সবশেষে বাংলাদেশের একটা পর্যায়ে এসে মিশেছে ব্রহ্মপুত্র নদে। তারপর যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা হয়ে বিলীন হয়েছে বঙ্গপোসাগরে। আমাদের এবারের অভিপ্রায় তিস্তা পাড় ধরে দুই চারদিন ঘোরা এবং সেখানকার মানুষের জীবন চিত্র কাছ থেকে দেখা। তবে তা বাংলাদেশে নয়, উৎসের দিকে গিয়ে; সিকিমের কাছাকাছি। তিস্তার কুল কিনারা ধরে বেশ কিছু জায়গায় লম্বা জার্নির পর ভেবে দেখি, সেই পাঁচদিন হয় বিছানা-তাবু নিয়ে শুধু ঘুরছি আর ঘুরছি। কিন্তু তিস্তা পাড়ে এখনও দুটি দিন কাটানো হল না।

সেই পরিস্থিতিতে মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর পূর্বের কথা। ইন্ডিয়ান এক পর্যটকের সাথে দেখা হয়েছিল ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো এক অনুষ্ঠানে। আলাপ পরিচয়ের পর তিনি আমার ইন্ডিয়া ভ্রমণের বৃত্তান্ত শুনে মন্তব্য করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তুমি ইন্ডিয়ার কিছুই দেখনি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহলে কী দেখলে বা কোন জায়গাগুলিতে গেলে ভেবে নিতে পারব যে, হ্যাঁ কিছু অন্তত দেখেছি। সাফ উত্তর, কাছে কুলে সর্বপ্রথম সিককিম দেখে এসো। উদ্দেশ্য পুরণে তার কথাগুলি মনে করে পা বাড়াই তিস্তার উজান সিকিমের দিকে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ক্ষেত্রে সিকিমে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। পরিস্কার করে বললে এক রকম নিষিদ্ধই প্রায়। অথচ, অন্যদের ক্ষেত্রে তাদের বিবেচনা কিন্তু অন্যরকম। আমাদের বেলায় এতটা সংরক্ষিত হওয়ার প্রকৃত কারণটি স্পষ্ট নয়।

রাঙ্গিত ও তিস্তার মিলনস্থল ত্রিভেনী

প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয়, দেখা যাচ্ছে কাগজপত্রসহ সবকিছু ঠিকঠাক  থাকার পরও বর্তমানে বাংলাদেশের বহু পর্যটককে ইন্ডিয়া ভিসা দিচ্ছে না। তাদের অপরাধ ট্রানজিট ভিসা না নিয়ে সড়কপথে নেপালে প্রবেশ করা। বিগত পাঁচ-ছয় বছর হয় তারা (ইন্ডিয়া) সড়কপথে নেপাল অথবা ভুটান গমণেচ্ছুদের ট্রানজিট ভিসা দেয় না বললেই চলে। কী কারণে দেওয়া হয় না, তা কেউ জানে না।

সুতরাং সড়কপথই একমাত্র ভরসা। পরিস্থিতি বিবেচনায় এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার পর্যটক ইন্ডিয়ান মাল্টিপল ভিসা নিয়ে তাদের দেশ হয়ে নেপাল ভ্রমণ করেছে। দেশের ট্যুর অপারেটর কোম্পানিগুলোও একই পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। সেক্ষেত্রে ইন্ডিয়া থেকে নেপালে প্রবেশ এবং নেপাল থেকে ইন্ডিয়া ফেরা; উভয়ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন সমস্ত প্রসেজ করে পাসপোর্টে ঠিকই অ্যারাইভাল-ডিপার্চার সিল দিয়েছে। পর্যটক নির্বিঘ্নে ঘুরে এসেছে হিমালয় কন্যা নেপাল। সংখ্যার হিসেবে যা, এ দেশ থেকে নেপাল ভ্রমণ করা পর্যটকের প্রায় সত্তর শতাংশ বা তারও অধিক।

ত্রিভেনীর পাড়ে লেখক

অথচ, বর্তমানে সেই পর্যটকরা পুনরায় ইন্ডিয়ান ভিসা আবেদন করতে গেলে ভিসা তো দিচ্ছেই না, বরং পাসপোর্টে একটি নেতিবাচক সিল মেরে দেওয়া হচ্ছে। বিনা ট্রানজিট ভিসায় একটি দেশের ভূমি ব্যবহার করে তৃতীয় কোন দেশে প্রবেশ অনুচিৎ, যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আপাতত নেই। মূলত সেই অনুচিৎ কাজটি করার দোষে-দুষ্ট প্রার্থীদেরকে ভিসার পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে ঐ সিল। প্রশ্ন হল, সীমান্তে যে তাদের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ পর্যটকদেরকে বিধি মেনেই নেপালে প্রবেশ করতে দিল, তা নিশ্চই তাদের দয়া-দাক্ষিণ্য বা কুটুম্বিতা ছিল না! বরং প্রতীয়মান হয় যে, সে সময় ইন্ডিয়া সরকারের ইচ্ছা বা নীতিটিই ছিল এরুপ। পরবর্তীতে ইচ্ছা হয়েছে খুশি মত নীতির পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আর ভুক্তভোগী হচ্ছে এ দেশের পর্যটকরা।


এমনও দেখা গেছে চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রয়োজন পড়লেও শুধু ঐ সিলের ভয়ে অনেকেই ভিসা আবেদন করা থেকে বিরত থাকছে। যেখানে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির দূতাবাসে ভিসা সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য জানতে গেলে স্বাগত জানিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সেখানে ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারে এরূপ সমস্যা বা যে কোনো বিষয়ে যোগাযোগ করতে চাইলে দেখা যায়, তার চৌহদ্দির ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। অন্য মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও সঠিক কোনো জবাব মেলে না। গত বছর শোনা গেল তারা বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পোর্টএন্ট্রি সুবিধা দিতে যচ্ছে। যে তালিকায় বাংলাদেশের নামও  ছিল। পরবর্তীতে কী যে হল, অজানা কারণে তালিকা থেকে আমরা বাদ পড়ে গেলাম। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাথে তাদের সমস্যাটা যে কোথায় তা আজও বোধগম্য নয়। অথচ, রাণীগঞ্জ (ইন্ডিয়া)-কাকরভীটা (নেপাল) সীমান্তে দেখা যায়, কিসের ইমিগ্রেশন, কিসের সীমান্তরক্ষী কোনো  কিছুর বালাই নেই। দুই দেশের রিকশা-ভ্যান, মোটরসাইকেল, হকাররা, যার যখন খুশি অবাধে যাতায়াত করছে। যাকে আসলে আন্তর্জাতিক সীমান্তই মনে হয় না। স্থানীয়দের কথায় জানা যায়, কার্যত নিজেদের স্বার্থেই ইন্ডিয়া এমন পরিস্থিতি করে রেখেছে। যা হোক, রাজনৈতিক কলাম বা প্রবন্ধ লেখা আমার কাজ নয়, সে যোগ্যতাও আমার নেই।

তিস্তা পাড়ে তাবু বাসস্থান

সিকিম যেতে চাইলে নাকী অন্তত ছয়মাস আগে দিল্লি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করতে হয়। তারপর অনুমতি দেওয়া না দেওয়া সম্পূর্ণ তাদের মর্জির ওপর  নির্ভরশীল। এসব জানার পরও দীর্ঘ জার্নি করে তিস্তার আশপাশ দিয়ে পৌঁছে যাই পশ্চিমবঙ্গ-সিকিম সীমান্তের কাছে। যদি সুযোগ একটা মিলে যায়! পথে কেউ কেউ বলে, যাত্রীদের তেমন কিছু জিজ্ঞেসই করে না, শুধু চালককে দিয়ে একটি এন্ট্রি খাতায় স্বাক্ষর করে নিয়ে ছেড়ে দেয়। একজন তো বললেন- আরে, ওসব কিছুই নয়, হাতে একটা ইন্ডিয়ান (হিন্দী ভাষার) পত্রিকা রাখুন, চেকার আসলে ভাবখানা এমন করুন যেন মনযোগ দিয়ে পড়ছেন। ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট। এমনও শোনা যায় অনেকে নাকি কলকাতা, শিলিগুড়ি থেকে ইন্ডিয়ান ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে নেয়। প্রয়োজনে এস্তেমাল করে দেদারসে  সিকিম ভ্রমণ করে আসে। সীমান্তে গিয়ে সেখানকার পরিস্থিতি প্রত্যক্ষপূর্বক সিকিম প্রবেশের ইচ্ছাটাকে অনুচিৎ বলে মনে হল।

তিস্তা পাড়ের পাথুরে বাঁধে বিশ্রাম

দুই একদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরির পর জিপচালক দাদার সঙ্গে আলাপ পরিচয়ে জানতে পাই ত্রিভেনী নামক এক বিশেষ জায়গার কথা। যেখানে তিস্তা নদীর ধারে তিস্তাগাঁও নামক এক বসতি রয়েছে। বসতি থেকে দুই আড়াই কিলোমিটার দূরে তিস্তা ও রাঙ্গিত নদীর মিলন স্থল। পর্যটকরা প্রায়ই সেখানে গিয়ে থাকে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রওয়ানা দিলাম। তিস্তাগাঁও-এ থাকার জায়াগা মাত্র একটি গোর্খা আর্মির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনি গোর্খার বাড়ি। নদীর কুলঘেঁষে পর্বতের ঢালু শরীরে গড়ে উঠেছে গ্রামখানি। ছোট্ট একটি বাজারও রয়েছে।

দুইতলা বাড়ি। নদীর একেবারে কুলঘেঁষে বানানো। ওপরতলায় পর্যটকদের থাকার বন্দোবস্ত। বিছানায় শুয়ে থেকেই শোনা যায় তিস্তার কলকলিয়ে বয়ে যাওয়ার মন মুগ্ধকর শব্দ। আর দ্বিতীয় তলার বারান্দায় বসলে তো নদীর স্রোত একেবারে পায়ের নিচে।

নদীর চেহারা আমাদের দেশের মতো নয়। উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম, রংপুর বা লালমনিরহাট গেলে তিস্তার যে রুপ দেখতে পাই- শুকনো মৌসুমে ধুধু বালুচর। তার মাঝদিয়ে খাড়ির মত লিকলিকে তিস্তা অথবা বর্ষায় দুকূল ভাসিয়ে উছলে যাওয়া, তেমন নয়। দুই-আড়াইশ মিটার প্রশস্ত হবে। কিন্তু মেজাজে ভীষণ খরস্রোতা এবং গভীর। দুইপাশে সুউচ্চ পর্বতমালা, তার তল দিয়ে চিড় ধরা ফাটলের মতো বয়ে যাচ্ছে। এরপর পাথুরে পার্বত্য এলাকা ছাড়িয়ে ভাটির দিকে এগিয়েছে আর ক্রমেই ভূমি বৈশিষ্টের কারণে প্রশস্ত  হয়ে উঠেছে, ছড়িয়েছে শাখা-প্রশাখা।

রাঙ্গিত ও তিস্তার মিলনস্থল ত্রিভেনী

যুদ্ধাহত জনি গোর্খার সারাটা দিন কাটে হুইল চেয়ারে বসে। গল্প করার বা কথা বলার তেমন কাউকে পান না। সর্বক্ষণ প্রতীক্ষায় থাকেন কে তার সঙ্গে  বসে খানিকটা কথা বলার জন্য এগিয়ে আসবে। ভীষণ স্মার্ট জনি আমাদেরকে পেয়ে অনেক খুশি। দুইকথা বলেই অন্দর মহলে খবর দিলেন কফি পাঠাতে। কাপড় চোপড় ছেড়ে সতেজ হওয়া তো দূরের কথা, থাকার ঘরটা দেখাই হয়নি। তার কথা -লম্বা জার্নি করে এসেছো প্রথমে এক মগ করে কফি পান করে চনমনে হয়ে নাও। তারপর বাদবাকি কারবার। সৈনিক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলা শুরু করতেই চলে আসে কফি। ছাগীর দুধে কফি, সহযাত্রী সিরাজুল মুস্তাকিম ও ইশতিয়াক আহমেদ দুজনেরই বেড়ে ওঠা নগর জীবনের যান্ত্রিকতার মাঝে। কফির স্বাদ কতটুকু হয়েছে, সেটা তাদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়। কফি যে ছাগীর দুধের তৈরি, তাতেই দুজনের চোখে মুখে তৃপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। আমার ক্ষেত্রেও যে তা হল না ঠিক তা নয়। কারণ গ্রামের ছেলে হলেও এমন উপকরণে কফি জীবনে এই প্রথম। কফি শেষে জনি গোর্খা এবার নিজ থেকেই ঘরে যেতে বললেন এবং এ-ও জানিয়ে রাখলেন, দ্বিতীয় দফা আলাপ হবে বিশ্রামের পর, সন্ধ্যায়।

পরের দিন সকালে জনি গোর্খার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে চললাম তিস্তার পাড় ধরে ত্রিভেনীর দিকে। নদীর বামপাশ ধরে পাহাড় কেটে তৈরি পথ। শুনশান নিরবতা। একটি মানুষও নেই। সেগুন গাছের শুকনো পাতাগুলি পরে রয়েছে। পায়ের নীচে পরে অনবরত মড়মড়িয়ে যাচ্ছে। নদীর পানি ছুটছে তার আপন গতিতে। ওপাড়ে মাথার ওপর পর্বতের দেয়াল ছেঁটে বানানো পথে দুএকটি গাড়ি যাচ্ছে। দেখতে যেন একেকটি পিপিলিকা। বহুদূর দার্জিলিং এর ওদিক থেকে রাঙ্গিত নামক নদী এসে তিস্তার এইখানাটায় মিলিত হয়েছে। দুই নদীর মিলন স্থল বলে জায়গাটি ত্রিভেনী  নামে পরিচিত।

তিস্তা পাড়ের পাথুরে বাঁধে বিশ্রাম

ত্রিভেনীতে রয়েছে মাঝারি এক বালুকাবেলা। সেই বালুকাবেলার সুবিধাজনক জায়গায় স্রোতের কাছাকাছি তাবু খাটিয়ে নিলাম। নিকটেই কয়েকজন জেলে আপন মনে মাছ শিকার করছে। এদিকে তাবু থেকে অল্প দূরত্বে একটি পাথরের ওপর আস্তানা গেড়ে বর্শি নিয়ে বসেছেন আর এক মাছ শিকারী। আশপাশে কোথায় কী হচ্ছে সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। এক ধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে বর্শির পাতাড়িরগুলির দিকে, আর ঠোঁটে জ্বলছে একটির পর একটি পাতার বিড়ি। সব মিলিয়ে ভ্রমণটা পূর্ণতা পেলেও আফসোস একটিই –র্যা ফটিং করা হয়ে উঠল না। জনি গোর্খার নিজেরই র্যা ফটিংয়ের সমস্ত ব্যবস্থা রয়েছে। টাকাও অর্ধেক কমিয়ে ধরবে বলেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, সংখ্যায় আমরা মাত্র তিনজন। দলে সদস্য অন্তত জনা ছয়েক হলে ভেবে দেখা যেত। তবে তাকে কথা দিয়ে এসেছি, পরবর্তীতে শুধু র্যা ফটিং করার জন্যই একবার আসব। অট্টহেসে তিনিও তার ফিফটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অফারটি ভ্যালিড থাকবে বলে নিশ্চিত করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ মার্চ ২০১৬/সাইফ