লোকগীতির কিংবদন্তির প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
দিলারা হোসেন : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:30 Dec 2015 12:37:29 AM Wednesday || Updated:30 Dec 2015 10:03:00 AM Wednesday

আব্বাসউদ্দিন শুধু একজন সংগীতশিল্পীই ছিলেন না, একজন অভিনেতাও ছিলেন। তবে ভাওয়াইয়া সম্রাট হিসেবেই অধিক পরিচিত। ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন গানের এই কিংবদন্তী।
পেশায় তিনি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তবে গান ছিল তার রক্তে। গান ছিল তার নেশায়। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আব্বাসউদ্দিনের পরিচিতি ছিল দেশজোড়া। আধুনিক গান, স্বদেশি গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। গানের জগতে তার ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। আপন প্রতিভাবলে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন আব্বাসউদ্দিন । তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নিজ চেষ্টায় গান গাওয়া রপ্ত করেন। তবে পরবর্তীকালে তিনি অল্প কিছু সময়ের জন্য ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছিলেন। রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া, ক্ষীরোল, চটকা গেয়ে আব্বাসউদ্দিন সুনাম অর্জন করেন। গানের নানা ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জন করলেও আব্বাসউদ্দিনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল লোকসংগীত। কলকাতাতেই পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। এরা উভয়ে মিলে কলিকাতা শহরে লোকসংগীত প্রচারে ব্রতী হন। এদের প্রচেষ্টা সফল হয় ও লোকসংগীত সম্পর্কে কলকাতা তথা নগরবাসী মানুষের মনে গভীর উৎসাহ জাগে।
আব্বাসউদ্দিন আহমদের বাবা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সংগীত জগতে প্রবেশ করেন।
আব্বাসউদ্দিন তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লি গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়। আব্বাসউদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচএমভি থেকে গানের রেকর্ড বের করেন। রেকর্ডগুলো ছিল বাণিজ্যিকভাবে ভীষণ সফল। তাই অন্যান্য হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান করতে থাকেন।
আব্বাসউদ্দিন ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। প্রথমে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে এবং পরে কৃষি দফতরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। চল্লিশের দশকে আব্বাসউদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭ সালে) ঢাকায় এসে তিনি সরকারের প্রচার দফতরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি নেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংগীত সম্মেলন, ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে আন্তার্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেন। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বিষ্ণুমায়’, ‘মহানিশা’, ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’। ‘আমার শিল্পীজীবনের কথা’ আব্বাসউদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ, যা প্রকাশ হয়েছিল ১৯৬০ সালে। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর প্রাইড অব পারফরম্যান্স (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন।
শিল্পী আব্বাসউদ্দীন বাবা হিসেবেও ছিলেন সফল। তার বড় ছেলে ড. মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি ছিলেন। মেজো ছেলে মোস্তফা জামান আব্বাসী একজন প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী ও লেখক। একমাত্র মেয়ে গুণী শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের নাম কারও অজানা নয়। সংগীতের ধারায় তৃতীয় প্রজন্মেও একটি সার্থক নাম নাশিদ কামাল।
পল্লিগানের সম্রাটের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলার কোটি হৃদয়কে কাঁদিয়ে তিনি চির বিদায় নেন। মাত্র ৫৮ বছরে আব্বাসউদ্দীন সংগীত জগতে যে অবদান রেখে গেছেন, তা এ জাতি যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে। তার প্রয়াণ দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ ডিসেম্বর ২০১৫/টিপু
No comments:
Post a Comment