Sunday, 27 December 2015

Long Live Bangladesh

যেতে হবে বহুদূর

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:27 Dec 2015   12:07:32 AM   Sunday   ||   Updated:27 Dec 2015   12:55:16 AM   Sunday
যেতে হবে বহুদূর
জাহাঙ্গীর আলম বকুল : বিশ্বের মানচিত্রে ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। শান্তিপ্রিয়। দেশটির পররাষ্ট্রনীতিই হচ্ছে- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। গত চার দশকেরও বেশি সময়ে সেটারই প্রমাণ দিয়েছে এ দেশ। বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে যেমন সু-সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দেশের প্রতিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তান নামের যে দেশটির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে, সেই দেশটির সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাস করে। প্রতিবেশী দেশের শান্তি বিনষ্ট হয় এমন পদক্ষেপ নেয়নি সৃষ্টির পর থেকে। বরং সারাবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এদেশের সন্তানেরা নিরালস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে- জাতিসংঘের শান্তি মিশনের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৭টি মিশনে এদেশের সামরিক বাহিনীর সাড়ে ৯ হাজারেরও বেশি সদস্য মোতায়েন রয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারা জীবন উৎসর্গ করেছে। অন্য দেশে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় এদেশের সেনারা নিয়োজিত থাকলেও অভ্যন্তরীণ শান্তিপ্রতিষ্ঠায় শক্তি প্রয়োগ করেনি এদেশের সরকার। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসীকারীদের সঙ্গে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনা করে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সীমান্তে বহুযুগের বিবাদমান ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেছে। নিজেরা শান্তিতে থাকে, অন্যকে শান্তি রাখতে চেষ্টা করে- এই হলো আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

এই দেশটির জন্ম হয়েছে বর্বর এক সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সেই বর্বর বাহিনী এদেশের মানুষকে যেমন হত্যা করেছে  তেমনি ২৪ বছরের শাসনামলে এদেশের অর্থনীতিকে নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। তালিকা তৈরি করে এদেশের প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক, চিসিৎসক, বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে দেশকে প্রতিভা শূন্য করে গেছে। তারপরও এ দেশের মানুষ হার মানেনি।

শান্তিপ্রিয় এ দেশের মানুষ সুযোগ পেলে কী করতে পারে, তা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর এ দেশে লোক সংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এর ৭০ ভাগই ছিল দরিদ্র। সম্প্রতি সংসদে পরিকল্পনা মন্ত্রী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেছেন, ২০১৪ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৭ ভাগ। দারিদ্র্য হার হ্রাসে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি। বিশ্বের মাত্র ২৪টি রাষ্ট্র গত এক দশক ৬ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। সত্তরের দশকে দেশে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ, আর আশির দশকে ৪ শতাংশ। এ বছর ৭ শতাংশের কাছাকাছি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, গ্যাস ও বিদ্যুতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, তাহলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে- এমন ধারণা অর্থনীতিবিদরা দিয়েছেন।

কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে সেখানে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিকে বিশ্বের ৫৬তম অর্থনৈতিক শক্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নয়নের বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে ৪০ বছর পর রাষ্ট্রটি বিশ্বের প্রধান ৩০টি অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। কয়েকদিন আগে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, বাংলাদেশ মাত্র তিন বছরে বিশ্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে ১৪ ধাপ এগিয়ে ৪৪তম অবস্থান অর্জন করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশ বিশ্বের ২৩তম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রায় দেড় যুগ ধরে যদি দেশটি সামরিক শাসনের অধীনে না থাকত, তাহলে অনেক আগেই উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যেত। নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও বিকশিত হয়েছে বেসরকারি খাত। জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে খাতটি।

প্রকৃতিগতভাবে এ দেশের মানুষ বৈরি পরিবেশে বাস করে। বিশ্বে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পানিতে প্লাবিত হচ্ছে এ দেশের উপকূল। বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে ডুবে থাকছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তারপরও এ দেশে অসীম সাহসী এবং লড়াকু কৃষকেরা তার দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। গত চার দশকে লোক সংখ্যা প্রায় দেড় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ভূমি বাড়েনি বরং কমেছে। সেই স্বল্প জমিতে সাইক্লোন, প্লাবন, বন্যার মধ্যেও ফসল ফলিয়ে ১৬/১৭ কোটি মানুষের অন্নের যোগান দিয়ে যাচ্ছে তারা। এখন বছরে প্রায় ৫ কোটি টন শস্য ফলাচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫০ থেকে ৭০ ডলার। সেই বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৪ সালে আয় ছিল ১০৮০ ডলার। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১৩১০ ডলার। ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৩৯ বছর। সংসদে পরিকল্পনামন্ত্রীর দেওয়া তথ্যমতে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ২০১৩ সালের ফল অনুযায়ী দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ দশমিক ১ বছর। শিশুমৃত্যুর হার চার দশকে হাজারে ১৮৫ জন থেকে ৪৮ জনে নেমে এসেছে। গুরুতর রোগের টীকার আওতায় এসেছে ৯০ শতাংশ শিশু। নিরাপদ পানীয় ও স্যানিটেশনের আওতায় এসেছে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। যা ভারত কিংবা চীনের চেয়ে বেশি।

জন্মের পর এই দেশটির টিকে থাকা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যু্ক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ঠাট্টা করে বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’। বিশ্বব্যাংক স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, সেখানে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়, সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম বাংলাদেশ। দেশটির মাথাপিছু গড় আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার যা ২০ বছরেও বাড়েনি। তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ২০ শতাংশের কম।

বিশ্বের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে উন্নয়ন নিয়ে সংশয়ে থাকা বাংলাদেশে আজ শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশের বেশি। স্বাধীন হওয়ার পর দেশে মাত্র ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। এখন দেশে ৩৭টি সরকারি এবং ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষা উপবৃত্তি, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের ফলে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে ‘বিপ্লব’ ঘটে গেছে। সরকারি হিসাব থেকে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে বর্তমানে ভর্তির হার শতকরা ৯১ ভাগ। যার মধ্যে মেয়ে শিশু ৯৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ছেলে ৮৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১২ ও ২০১৩ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় মেয়ে পরীক্ষার্থী লক্ষাধিক বেশি ছিল। জুনিয়র সমাপনী পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ২০১৩ সালে লক্ষাধিক বেশি ছিল মেয়ে পরীক্ষার্থী।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশে গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নানান সমস্যাসংকুল সময় পার করতে হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশিত গণতন্ত্র কখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে অবরুদ্ধ করে দাবি আদায় না করত, যদি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলতে পারত, তাহলে দেশ যে কতদূর এগিয়ে যেত, তা গত ছয়/সাত বছরের দিকে তাকালে ধারণা পাওয়া যায়। ছয়/সাত বছর দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হওয়ায় অর্থনৈতিক ‘বিপ্লব’ শুরু হয়েছে। দেশে মিডিয়ার বিপ্লব ঘটেছে। যা এখন গণতন্ত্রের পাহারাদারের ভূমিকা পালন করছে। স্বাধীনের পর দেশে একটি মাত্র টেলিভিশন এবং কয়েকটি পত্রিকা ছিল। এখন দেশে ৪৩টি বেসরকারি টেলিভিশনের সরকারি অনুমোদন রয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রচারে আছে ২৪টি। প্রতিদিন শতাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে শুধু রাজধানী ঢাকা থেকে। সময়ের চাহিদা পূরণ করতে শুরু হয়েছে অনলাইন গণমাধ্যম। সত্তরের দশকে উপজেলা শহরে হাতে গোনা কয়েকটি টেলিভিশন থাকলেও এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের একটি বাড়িতে কয়েকটি রঙিন টেলিভিশন শোভা পায়।

১৯৭২ সালে দেশে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ছিল মাত্র ছয়টি। এখন দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত এবং প্রাইভেট মিলে ৫৬টি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ সব ব্যাংকের কয়েক হাজার শাখা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও চালু রয়েছে। প্রায় ৪ কোটি মানুষ এসব ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী সংস্থা হতে ঋণ নিয়ে উৎপাদনে নিযুক্ত থাকছে। দূরন্তগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের আইটি খাত। কয়েক বছরের ব্যবধানে আইসিটিখাতের রফতানি ৩০০ মিলিয়ন ডলার পার হয়েছে। এখাতে কর্মসংস্থান হয়েছে দুই লাখেরও বেশি মানুষের।

৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৫০১ কোটি টাকার। সেই দেশে আগামী অর্থ বছরের বাজেট সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যে দেশের এক সময় মোট আমদানি ব্যয়ের ৭০ ভাগই মেটানো হতো বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানে। আর আজ তা মেটানো সম্ভব হচ্ছে সম্পূর্ণ নিজস্ব আয়েই। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার। আর কোনো তথ্য-উপাত্তের দরকার নেই, দেশ গত ৪৪ বছরে কতটা এগিয়েছে তা বুঝানোর জন্য।

২০-২৫ বছর আগে গ্রামে দেখতাম, বয়স্করা হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরে হাটে-গঞ্জে যেতেন। হাটে-গঞ্জে যাওয়ার জন্য এ রকম দু-একটি গেঞ্জিই ছিল তাদের ‘ভালো পোশাক’। সারাদিন মাঠে কাজ করতেন উদোম গায়ে। আর আজ, সেই কৃষকের সন্তানেরা হাল ফ্যাশনের জামা পরে, হাতে দেখা যায় সেরা ব্র্যান্ডের স্মার্ট মোবাইল ফোন। তাদের বাসায় শোভা পায় রঙিন টেলিভিশন। পরিবর্তন যে এসেছে তা সবখানে স্পষ্ট। এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বিদেশ বিভুঁইয়ে নিরানন্দ পরিবেশে ৯০ লাখ বাংলাদেশির হাড়ভাঙা খাটুনিতে, ৪৪/৪৫ লাখ পোশাক শ্রমিকের উদয়-অস্ত পরিশ্রমে, কোটি কোটি কৃষকের লড়াকু সংগ্রামে। সর্বোপরি সম্ভব হয়েছে- এ দেশের সূর্য সন্তানেরা জীবন দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছে বলেই।

লেখক: সংবাদকর্মী।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ডিসেম্বর ২০১৫/বকুল/শাহনেওয়াজ

No comments:

Post a Comment