যেভাবে হলো অস্কারের লাল গালিচার প্রচলন
মারুফ : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:29 Feb 2016 12:06:51 AM Monday

তাই অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোর মূল পর্বের পাশাপাশি সবার নজর থাকে এই বিশেষ লাল গালিচার দিকে। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোতে এখন অপরিহার্য অংশ রেড কার্পেট। কিন্তু এই রেড কার্পেট বা লাল গালিচার প্রচলন কীভাবে হলো তা কী জানেন? যদি জানা না থাকে তাহলে চলুন জেনে নিই, কীভাবে হলো রেড কার্পেটের প্রচলন।
প্রাচীনকালে রেড কার্পেট বা লাল গালিচায় পা রাখা সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তখন মনে করা হতো লাল গালিচায় একমাত্র দেবতারাই পা রাখতে পারেন, সাধারণ মানুষ নয়। মনে করা হয়, সাধারণ মানুষের লাল গালিচায় পা রাখার প্রচলন হয় প্রাচীন গ্রীসে। অ্যাস্কাইলাসের ‘অ্যাগামেমনন’ গল্পে দেখা যায় গল্পের মূল চরিত্র অ্যাগামেমনন যখন ট্রোজান যুদ্ধ শেষ করে ফিরছিলেন তখন তার প্রতিশোধ পরায়ন স্ত্রী ক্লাইটেমনেস্টা তাকে স্বাগত জানানোর জন্য লাল গালিচা বিছিয়েছিলেন। সে সময় অ্যাগামেমনন তার সামনে বিছানো লাল গালিচায় পা রাখতেও দ্বিধাবোধ করছিলেন। কারণ তিনি একজন মর্ত্যের মানুষ ছিলেন, দেবতা ছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি পা রেখেছিলেন এবং তার পরিণতিও ভয়াবহ হয়েছিল।
ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামের সিনিয়র কিউরেটর সনেট স্ট্যানফিল বলেন, ‘এটি খুব মজার বিষয় যে, রেড কার্পেট এখন চলচ্চিত্র তারকাদের সঙ্গে অতপ্রতভাবে জড়িত এবং তাদের বর্তমান সময়ে অভিজাত শ্রেণীর মানুষ বলে মনে করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে ‘পিকচার হাউজ’ এর আবির্ভাব হয়, সেখানে রাজকীয় ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল। সেখানে তাদের স্বাগত জানানোর জন্য এক ধরনের বিশেষ কার্পেট ব্যবহার করা হতো, এখন তারকাদের স্বাগত জানানোর জন্য লাল গালিচা ব্যবহার করা হয়।’
রেঁনেসা যুগে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের লাল গালিচা দেখা যেত যেখানে নানা রকমের নকশা দেখা যেত। ওই লাল গালিচাগুলোতে দেবতা, যাজক এবং রাজকীয় সব নকশা করা থাকত। কিন্তু সেগুলো কেন করা হতো?
এ বিষয়ে স্ট্যানফিল বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই লাল রঙটার সঙ্গে মর্যাদা, রাজকীয়তা এবং আভিজাত্যের বিষয়টি সম্পৃক্ত। ‘স্কারলেট’ ছিল সবচেয়ে দামি রঙ এবং এটি তৈরি করাও ছিল খুবই কঠিন।’
কচিনিয়েল বা কার্মাইন শুরু থেকে এবং এখনো এক ধরনের পোকার আঁশ দিয়ে গালিচার রঙ তৈরি করা হয়। পনের শতকের দিকে উত্তর এবং মধ্য আমেরিকার আজতেক এবং মায়া সভ্যতার মানুষেরা নকশার জন্য কচিনিয়েল ব্যবহার করত। সতের শতকের দিকে কচিনিয়েল রঙ বেশ দামী পণ্যে পরিণত হয়।
পরবর্তী সময়েও স্কারলেট রঙ দিয়ে নকশা করার মূল্য হারিয়ে যায়নি এবং আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এটি ব্যহৃত হতো। ১৮২১ সালে দক্ষিণ ক্যারোলিনার জর্জটাউনে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোকে স্বাগত জানানোর জন্য ব্যবহার করা হয় স্কারলেট কার্পেট।
তারপর থেকেই উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে লাল গালিচা। লাল গালিচায় আমন্ত্রণের বিষয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আসে ১৯০২ সালে। নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদের স্বাগত জানানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল লাল গালিচা।
হলিউডের সঙ্গে লাল গালিচার সম্পৃক্ততা হয় ১৯২০ সালের দিকে। ১৯২২ সালে ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্ক অভিনীত রবিন হুড সিনেমার প্রিমিয়ারে ইজিপ্টের একটি থিয়েটারের সামনে লাল গালিচা ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু জায়গায় লাল গালিচার ব্যবহার দেখা যায়। এবং ক্লার্ক গ্যাবল, জিমি স্টুয়ার্ট এবং গ্রেস কেলির মতো তারকাদের লাল গালিচায় দেখতে পায় মানুষ।
এরপর ১৯৬১ সাল থেকে অ্যাকাডেমি অ্যাওযার্ড অনুষ্ঠানে লাল গালিচার ব্যবহার শুরু হয়। সান্তা মনিকার সিভিক অডিটরিয়ামে বিছানো হয় লাল গালিচা। তার কয়েক বছর পর থেকেই অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান অডিটোরিয়ামের বাইরের দৃশ্য সম্প্রচার শুরু হয়। অতিথিরা ঝলমলে পোশাক পরে অনুষ্ঠানে হাজির হন এবং তা প্রচার করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পায় লাল গালিচার ব্যবহার। তারকাদের মূল ভাবনায় থাকত অস্কারের মূল আসরে আকর্ষণীয়ভাবে হাজির হওয়া।
এরপর থেকেই হলিউডে লাল গালিচার আবশ্যকতা বেড়ে যায়। অতীতের রীতি ভেঙে তারকারা আরো খোলামেলা এবং বাহারি পোশাকে লাল গালিচায় উপস্থিত হতে শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে অস্কারে ফানি গার্ল সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার পেয়ে যতটা না আলোচনায় এসেছিলেন, তার চেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছিলেন তার পোশাকের কারণে।
১৯৭০ সালের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেই সময়ের আলোচিত জুটি এলিজাবেথ টেইলর এবং রিচার্ড বার্টন লাল গালিচায় হাজির হয়ে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন। স্বামী রিচার্ড বার্টন ওই বছর অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং টেইলর অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন বেগুনি পোশাক এবং হীরের নেকলেস পরে।
১৯৭৮ সালে ডিয়ানে কেটন আকর্ষণীয় পোশাকে অ্যানি হলের হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেন। এরপর আমেরিকান গায়িকা-অভিনেত্রী সেয়া তার নিত্যনতুন পোশাকের জন্য আলোচনায় আসতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে মুনস্ট্রাক সিনেমায় একজন কুসংস্কারচ্ছন্ন বিধবার চরিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিলেন। সে বছর তার কালো রঙের খোলামেলা বব ম্যাকি পোশাক আজও আলোচিত হয়ে আছে।
লাল গালিচায় উপস্থিতি এখন তারকাদের ক্যারিয়ারের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৪ সালে এলিজাবেথ হার্লি ফোর ওয়েডিং অ্যান্ড অ্যা ফিউনেরাল প্রিমিয়ারে হিউ গ্রান্টের সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে তার পরিহিত ভার্সাস পোশাকের জন্য ব্রিটেনে রাতারাতি আলোচনায় আসেন এ অভিনেত্রী। তার পোশাকের মূল আকর্ষণীয় বিষয় ছিল- পোশাকের পাশের দিকে বড় বড় সেফটি পিনের ব্যবহার। তার সেই পোশাকের কারণে অনেকে অভিনেত্রী স্ট্রেইস্যান্ড এবং গায়িকা সেরের উত্তরসুরী উপাধি দেন।
১৯৯০ সালের দিকে ফ্যাশন এবং চলচ্চিত্র একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে এবং এ দুটিকে একসঙ্গে হাজির করা হয় লাল গালিচায়। লাল গালিচায় প্রাধান্য বিস্তার করত এমন কয়েকজন ডিজাইনারের মধ্যে ছিলেন- ভলেনটিনো এবং জর্জিও আরমানি। ১৯৯৭ সালে অভিনেত্রী নিকোল কিডম্যান জন গ্যালিয়ানোর তৈরি সবুজ রঙের ডিওর গাউন পরে লাল গালিচায় হাজির হয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। ২০০০ সালের শুরুতে রেনে জেলওয়েগার এবং জুলিয়া রবার্টস লাল গালিচায় হাল ফ্যাশনের তোয়াক্কা না করে অতীত সময়ের ফ্যাশনকে তুলে ধরেন। অন্যদিকে আইসল্যান্ডিক গায়িকা-অভিনেত্রী বোয়ার্কদার স্মরণীয় মার্জান পেজস্কি সোয়ান পোশাকে লাল গালিচায় হাজির হয়ে নিজেকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান।
এখন অস্কারের লাল গালিচা অনেক বড় আকারের করা হয়। তার আয়তন ১৬ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফিট। এবং এটি বিছানোর জন্য দুই দিন সময় প্রয়োজন হয়। প্রতি বছর অস্কার অনুষ্ঠানে মিডিয়ার মূল আকর্ষণ থাকে এই লাল গালিচা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/মারুফ/শান্ত
No comments:
Post a Comment