Sunday, 21 February 2016

Poet Robi in the morning

সকালবেলার রবি

মৌসুমি চৌধুরী দাসগুপ্ত : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:21 Feb 2016   06:42:12 PM   Sunday   
সকালবেলার রবি
মৌসুমি চৌধুরী দাসগুপ্ত : কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেউ কখনও হাত দিয়ে খেতে দেখেননি। তিনি খেতেন কাঁটা-চামচ দিয়ে । অত্যন্ত মিতাহারী ছিলেন। সব মিলিয়ে দু-তিন চামচ পরিমাণ খাবার খেতেন। তাই বলে তাঁকে কম করে খাবার দেওয়া চলত না; অসন্তুষ্ট হতেন। থালায়, বাটিতে নানা রকম খাবার সাজিয়ে সামনে ধরা হত, তিনি বাটির ঢাকনা খুলে খুলে আগে দেখতেন কি কি আছে। তারপর অমুকে মাংস ভালোবাসে তার বাড়িতে মাংসের বাটিটা, অমুকে মাছ ভালোবাসে তাকে মাছের বাটি পাঠিয়ে দিতেন। কারো জন্য চপট, কারো জন্য পায়েস, কারো জন্য বড়ির ঝোল; এই করে প্রায় সবটাই বিলি হয়ে যেত। কাছে কেউ থাকলে তাকে সেখানে বসিয়েই খাওয়াতেন। খাওয়াতে, খাওয়া দেখতে রবীন্দ্রনাথ খুব ভালোবাসতেন।

ভোরে অন্ধকার থাকতেই চুলো ধরিয়ে বনমালী চা করে আনত। সেই চা পান করে রবীন্দ্রনাথ লেখায় মগ্ন হয়ে যেতেন। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই সকালের দিকে আশপাশের দু-চারজন আসতেন সেখানে। কবি তাদেরকে নিজের হাতে চা ঢেলে পান করাতেন। অনেক সময় তাঁদের আসতে দেরি হলে তিনি অপেক্ষায় বসে থাকতেন।

সকালবেলা মানুষ ছাড়াও আরো প্রাণী আসত তাঁর চা-এর আসরে। বৌঠান একটা ময়ূর কিনে বাগানে ছেড়ে দিয়েছিলেন- বাগানে ঘুরে বেড়াবে, সুন্দর লাগবে দেখতে। ময়ূর বাগানের শোভা বাড়ালো ঠিকই কিন্তু বাগানে কেউ আর ঢুকতে পারে না। যে আসে তাকেই ময়ূরটা তেড়ে এসে নখ দিয়ে আঁচড়ে দেয়। অনেকে ক্ষতবিক্ষত হলেন। ছোটোদের বারণ করে দেওয়া হল বাগানে ঢুকতে; যদি ময়ূর চোখ উপড়ে নেয়! চোখের উপরেই নাকি ঝোঁক বেশি ময়ূরের।

রবীন্দ্রনাথ মৃন্ময়ীর চাতালে বসে চা পান করতেন। ময়ূরটি রোজ তার কাছাকাছি এসে পেখম ঝুলিয়ে বসে থাকত। ময়ূর দেখে ভয়ে একপায়ে দুপায়ে সবাই সরে পড়ত। খানিকটা দূর থেকেই সকলে দেখত রবীন্দ্রনাথ কবিতার খোলা খাতা কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দেখছেন ময়ূর; ময়ূর দেখছে তাঁকে। মিনিটের পর মিনিট চলে যেত এইভাবে। সে যে কি সুন্দর ! মনে হত রঙিন ছবি একটি। কোনো কোনোদিন দেখা যেতো রবীন্দ্রনাথ লিখেই যাচ্ছেন, তার তাকানোর অবসর নেই। ময়ূর কিন্তু তেমনিভাবেই কাছে এসে বসে আছে। কবি লিখছেন। ময়ূর একসময় ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত নিচের বাগানে। কবি মুখ তুলে দেখে আবার চোখ নামিয়ে নিতেন লেখার পাতায়।

কবি রবীন্দ্রনাথের একটি কুকুর ছিলো, নাম লালু। দেশী কুকুর হলেও চেহারা ছিলো দশাসই। কখন কোথায় থাকতো কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিলো না। কিন্তু সকালবেলা এসে হাজির হত সামনে। গুরুগম্ভীর চাল তার; এসে যখন কবির পায়ের কাছে সামনের দুপায়ে ভর রেখে বসত, দেখাত ঠিক যেন পাথরে খোদাই করা মূর্তি। গুরুদেব চেয়ে দেখতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন; লালু স্থির হয়ে বসে মুখে গঁ-গঁ শব্দ করে লেজ নাড়ত। গুরুদেব পাঁউরুটিতে পুরু করে মাখন লাগিয়ে লালুকে দিতেন। লালু খেত। খাবার সময়েও লালুর এতটুকু চপলতা প্রকাশ পেত না। গুরুদেব বলতেন, এর কি ডিগনিটি দেখেছ? এমন ভদ্র কুকুর দেখা যায় না বড়ো।

বনমালীর এটা খুব লাগত। একটা কুকুর খায় এতখানি করে মাখন রোজ! এক একদিন লালুকে আসতে দেখলেই বনমালী তাড়াতাড়ি আগে থেকেই লালুর প্রাপ্য রুটিখানা মাটিতে রেখে টেবিল থেকে পেয়ালা, প্লেট, মাখন, চিনি সব তুলে নিয়ে চলে যেত। লালু এসে শুঁকে শুঁকে যখন টের পেত মাখন নেই, সেই রুটি স্পর্শও করত না। গম্ভীরভাবে হেলেদুলে কবির আরো পা ঘেঁষে বসত। কবির খেয়াল হত, চেয়ে দেখতেন লালুর রুটি মাটিতে পড়ে, বুঝতেন কি ব্যাপার, বনমালীকে বলতেন, লালু খায় নি আজ, দেখেছ?

বনমালী বলত, তা আজ্ঞে কি করব আমি। রুটি তো হোথায় ঐ দিয়ে রেখেছি, দেখুন-না কেন?
কবি বলতেন, সে তো জানি, আর এও জানি তুমি শুকনো রুটি দিয়েছ খেতে। জানো, লালু মাখন ছাড়া রুটি খায় না। নিয়ে এসো মাখনের বাটি এখানে, আমি নিজে মাখন লাগিয়ে দেব।

কোনোদিন আবার কবি লেখায় ডুবে গেছেন লালু আসার আগেই। লালু এসে অভ্যাসমত বসে কিন্তু কবির নজর আর পড়ে না। সেদিনগুলোতে বনমালী পিছন দিক থেকে ইশারায় ডেকে নিত লালুকে। লালু এদিক-ওদিক তাকিয়ে সরে আসতো। বনমালী শুকনো রুটি একখানা ছুঁড়ে দিত, যেন এতদিনের মাখন খাওয়ার শোধ । বলতো বনমালী, ‘খা আজ এই-ই, দেখি মাখন ছাড়া কেমন না রোচে। খেয়ে চলে যা এখান থেকে।’

লালু যেন বুঝতে পারতো অবস্থা বেগতিক। কিছুমাত্র আপত্তি না জানিয়ে সেদিন মাখন ছাড়াই সে রুটি খেয়ে নিতো। অথচ কবির কাছে কখনো এমন রুটি খেত না, শুঁকে মুখ সরিয়ে নিত। এ মজা যে কতবার দেখা গেছে! এই লালুকে নিয়েই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কবিতা -

প্রত্যহ প্রভাতকালে ভক্ত এ কুকুর
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে আসনের কাছে
যতক্ষণে সঙ্গ তার না করি স্বীকার
করস্পর্শ দিয়ে।
এটুকু স্বীকৃতি লাভ করি
সর্বাঙ্গে তরঙ্গি উঠে আনন্দপ্রবাহ।
শেষে আছে -
ভাষাহীন দৃষ্টির করুণ ব্যাকুলতা
বোঝে যাহা বোঝাতে পারে না -
আমারে বুঝায়ে দেয় সৃষ্টি-মাঝে মানবের সত্য পরিচয়।।

এ ছাড়াও ধান চাল মুড়ি ছড়িয়ে দেয়ার বরাদ্দ ছিল রোজ সকালে শ্যামলীর সামনে। কাক শালিক পায়রা ঘুঘুর মেলা বসত কবি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। আর এভাবেই সকালে দিন শুরু হত কবির।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শাহনেওয়াজ/তারা

No comments:

Post a Comment