Monday, 25 January 2016

Michale modushudon dotto a great poet

মধুসূদন দত্ত : পূর্ণ মণিজালে

অলাত এহ্‌সান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:25 Jan 2016   12:22:19 AM   Monday   ||   Updated:25 Jan 2016   10:57:07 AM   Monday
মাইকেল মধুসূদন দত্ত

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

অলাত এহ্‌সান : ভারতবর্ষের ইতিহাসে উনবিংশ শতক যতগুলো কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে তার মধ্যে দুটি দিক খুবই স্পষ্ট। এক. বিভিন্ন সংগ্রাম এবং দুই. সাহিত্য। ১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থান, যা ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে ততোধিক পরিচিত, প্রকৃত অর্থে ভারতীয়দের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। তার ঠিক পাঁচ বছর আগে আদিবাসী গণ-অভ্যুত্থানও নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য আরেকটি ঘটনা। একই সময়ে ভারতের রেঁনেসাখ্যাত যে জাগরণ- এই রেঁনেসা মূলত সাহিত্য সঞ্চাত। বিষয়টা মোটেই ইচ্ছা নিরপেক্ষ কিছু ছিল না যদিও। তবু এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্যচর্চার ইতিহাস দারুণভাবে বদলে যায়।

সমাজ সংস্কারে উদ্বুদ্ধ সাহিত্যিকদের কথা ধরেও নিপাট সাহিত্যচর্চা বিবেচনায় আমার মনে হয় সাহিত্যে সেই রেঁনেসার নেপথ্য নায়ক মাইকেল মধুসূদন দত্তকেই বলতে হবে। কারণ তিনিই বাংলা সাহিত্য বিদীর্ণ গলি পথ থেকে এক ধাক্কায় আধুনিক মহাসড়কে চলতে বাধ্য করেছিলেন। সাহিত্যের দেখানো পথ ধরেই যে সমাজ সংস্কার এগিয়ে গেছে তা আজ বিতর্কের উর্ধ্বে। সাহিত্যের ইতিহাস ঘাটলেও এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে।

প্রথম থেকে এবং প্রথাগতভাবেই কবিতা ছিল বাংলা সাহিত্যের আদি পথ। উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে আবার গদ্যের মহা উন্মেষ দেখা যায়। মধুসূদন সেই আদি পথে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে ধীর লয়ে চলা পুরনো যানবাহনের পাশে যেন আধুনিক শকট প্রচণ্ড গতিতে চালিয়ে দেখান। সেই আদিম শরীরে আধুনিক প্রাণের সঞ্চারও ঘটে এতে। বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম সনেট ও চতুর্দশপদী অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন। এই সাহিত্য ধারা তার নাটকের মধ্যেও প্রয়োগ ঘটান। অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করে তিনি ‘পদ্মাবতী’ নাটক রচনা করেন। এ ছাড়াও তিলোত্তমাসম্ভব(১৮৬০),  ব্রজাঙ্গনা (১৮৬১), বীরাঙ্গনা (১৮৬২) কাব্যগ্রন্থগুলো অমিত্রাক্ষর ছন্দেই লেখা।

তার চতুর্দশপদী কবিতাবলী(১৮৬৬) গ্রন্থভূক্ত ‘কপোতাক্ষ নদ’ ও ‘বঙ্গভাষা’ গ্রন্থদ্বয় সনেট সংকলন। মধুসূদনের সাহিত্য উন্মেষের সঙ্গে তার ভাষা শিক্ষা প্রসঙ্গটি নানাভাবে জড়িত। তার জন্মস্থান সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রাম শেখপুরা মসজিদের ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসী ও আরবি শেখেন। বিশপ কলেজে পড়াশোনার সময় শেখেন গ্রিক, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়, লাতিন, সংস্কৃতসহ প্রায় ১৩-১৪টি ভাষা। তবে শুধু উনবিংশ শতাব্দিই নয়, গোটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ছেঁকে যদি তুলে আনা হয় তাহলেও মাইকেল মধুসূদনের কবি জীবন সবচেয়ে বিস্ময় জাগানিয়া। সাহিত্যের মতো তার জীবনও পাঠকের কাছে সমান আকর্ষণীয়। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, অনেকের কাছে মধুসূদনের কাব্য প্রতিভার স্পর্শ না পৌঁছালেও জীবন কাহিনী পৌঁছে গেছে। বলা ভাল, তার জীবনের বৈপরিত্য ও বিদ্রোহ সবার আকর্ষণ।

ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের বিখ্যাত দত্তবাড়িতে তার জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। তিনি ছিলেন পিতা রাজনারায়ণ দত্তের প্রথম পত্নী জাহ্নবী দেবীর সন্তান। সেই আমলেই তার পিতা কলকাতার ডাকসাইটে আইন ব্যবসায়ী ছিলেন। কলকাতার খিদিরপুর সার্কুলার গার্ডেন রিচ রোডে (বর্তমানে কার্ল মার্ক্স সরণী) বিশাল বাড়িও করেছিলেন তার বাবা। তিনি চাইতেন যথারীতি মধুসূধন আইন ব্যবসায়ী হবে। কিন্তু মধুসূদনের প্রথম বিদ্রোহ এখানেই। তিনি যথারীতির বাইরে যেতে চেয়েছেন। যে কারণে শিক্ষা জীবনে মেধাবী মধুসূধনের প্রথম থেকেই ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজি ভাষায় তার অগাধ দখলই তাকে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে।

আমাদের মনে রাখা দরকার, সে সময় ভারতবর্ষে  ইংরেজি একটি ঔপনিবেশিক ভাষা। মধুসূদন এই ঔপনিবেশিকতা দ্বারা কম-বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন তা বোধ হয় অস্বীকার করা যায় না। যুগপৎভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার বিদ্রোহও ছিল। যে কারণে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যচর্চা করলেও রচনা রীতি ছিল ইউরোপিয়। তিনি ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন- প্রায়শ এই দোষে মধুসূদনকে দোষী করা হয়। আজকের দিনে কথাটার একটা পুনঃমূল্যায়ন করা যেতে পারে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বিশ্বায়নের এই যুগে সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা এখন আর দোষের চোখে দেখা হয় না। কাঁটাতার বেষ্টনে আলাদা আলাদা প্রতিটি রাষ্ট্রেই এক-দুজন পাওয়া যাবে যারা ইংরেজি সাহিত্যচর্চা করেন। এবং দেশে এই সাহিত্য চর্চার নূন্যতম একটা গ্রহণযোগ্যতাও আছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মধুসূদনকে নিয়ে মূল্যয়ন করতে গিয়ে আমরা যেন উনবিংশ বা বিংশ শতাব্দিতেই বাস করি। ফলে তার মূল্যায়নে একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়।

আবার আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করা যেতে পারে এখানে। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের আজকের যে অবস্থান, উনবিংশ শতকে তা মোটেই ছিল না। বরং উপনিবেশ হিসেবে, বাজার হিসেবে হীন করে দেখা হতো তাকে। যে কারণে আমরা দেখি, উনবিংশ শতকে অনেক সাধারণ মাপের চিত্রকর ভারত বর্ষে আসছে কিছু করে খাওয়ার জন্য। বিংশ শতকের শুরুতে ভারতবর্ষের মুক্তির আন্দোলনগুলোই বিশ্বের মানুষকে ভারতবর্ষ নিয়ে নতুনভাবে ভাবার অবকাশ তৈরি করে দেয়। মধুসূদন উত্তর সময়ের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব নজরে আসার একটা নূন্যতম কারণগুলোর এটা একটা কারণ বটে, যিনি শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কারও জয় করলেন।

বিশ্ব-রাজনীতিতে ভারতের বর্তমান অংশগ্রহণের কারণেই ভারতের প্রতি মানুষের আগ্রহ নতুন করে তৈরি হয়েছে। যা ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদের তাগিদ তৈরি করেছে, একইভাবে ইংরেজিতেও ভারতীয় সাহিত্য চর্চার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এই চর্চা এতটাই বিস্তৃত যে, ভারতের অনেক সাহিত্যিকই ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে এখন বিশ্ব পুরস্কার জয় করছেন। আমার একান্তভাবেই মনে হয়, সেই সময়ের বাস্তবতায় মধুসূদনের সাহিত্যের তেমন মূল্যয়ন করা হয়নি। হলে লেখনী গুণে বিশ্ব দরবারে ঠাঁই করে নেয়া তার জন্য খুব কঠিন কিছু ছিল না।

যে কথাটি বলছিলাম, তার জীবনের বৈপরিত্য। যা তাকে যুগপৎ কবি ও কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করেছে। প্রথমত সনাতন ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করার তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজে বিস্ময় ও সংস্কার জাগানিয়া ঘটনা। যে কারণে ধর্মান্তরের চার বছর পর পর্যন্ত বাবা তার পড়ার খরচ দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেন। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও দীন-হীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, যা স্পর্শকাতর মনে তরঙ্গ তৈরি করেই। অবশ্য পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ নামক প্রথম কাব্যটি রচনা করেন। তখনই কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তার সুনাম তৈরি হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্য জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি এটা একটা ট্রাজেডি। যা তার ভেতরে এক ধরনের আত্মপীড়ন তৈরি করে। পরে বন্ধুদের উৎসাহে বাংলায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। এখানে তিনি সর্বোচ্চ সিদ্ধি লাভ করলেও এই বাংলা ভাষায় ফিরে আসা, ইউরোপ ছেড়ে বাংলায় থিতু হওয়ার মতো ঘটনা পাঠকের চোখে তাকে ভিন্নভাবে উপস্থিত করে। যথেষ্টার্থেই সাহিত্যের মতো জীবন সম্পর্কেও তিনি ইউরোপ দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। বিখ্যাত ইংরেজ কবি পার্শি বিসি শেলি কিংবা লর্ড বাইরনের ছাপ তার ভেতরেও পাওয়া যাবে। যদিও ইংরেজি সাহিত্যে প্রবেশের সংগ্রাম তার মধ্যে দারুণ ভাবে ছিল।

এই প্রভাব তাকে সংস্কার মুক্ত ভাবে সেই সময়ের সমাজের অনেক বিচ্যুতি-অনাচারের বিরুদ্ধে তীক্ষ্মভাবে লিখতে সাহায্য করেছে।  শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে প্রহসন দুইটি- ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’-এর মাধ্যমে তিনি আঘাত করেছেন। যে কারণে এই নাটকগুলো তখন মঞ্চে নিষিদ্ধ করা হয়। মাত্র তিন বছরের (১৮৫৯-৬১) নাট্যচর্চায় একটি অসমাপ্ত নাটক বাদে মোট ৫টি রচনা করেন তিনি। দুঃখজনক হলেও, ওই দুটিকে প্রহসন বলে অনেক সময় খাটো করা হয়। ১৮৫৯ সাল তার রচিত পৌরাণিক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ই বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক। তার অন্যান্য নাটকের মধ্যে আছে ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)। মৃত্যুর পূর্বে ‘মায়াকানন’ (১৮৭৪) নামে আরেকটি নাটক শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি।

‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নামক মহাকাব্যটির জন্য বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন দত্ত অমর হয়ে আছেন। রামায়ণ উপাখ্যান অবলম্বনে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাকাব্যটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। একে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য হিসেবে ধরা হয়। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও তাতে গ্রিক ইলিয়ড ও ওডিসি’র প্রভাব দেখা যায়। যে কারণে শুরুতে বীর রসে লেখার ঘোষণা দিলেও শেষে তা ট্রাজেডিতে পরিণত হয়।

আজকের দিনে তার সাহিত্যকীর্তির ব্যাপক উন্মেষই তার জীবনের ট্রাজেডিকে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়। ব্যক্তি জীবনের মতো তার পেশাজীবনও স্থির ছিল না কখনোই। এর মাঝেও তিনি যে সনেট, চতুর্দশপদী, নাটক, প্রহসন, অনুবাদ, সাংবাদিকতাসহ নানা সাহিত্য কর্মকাণ্ড চলিয়ে গেছেন। এসব থেকে সহজেই অনুমেয় তার ভেতর কতটা মণি পূর্ণ ছিল। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে, কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা সাহিত্যে তার বিপুল বিশাল অবদান কখনোই ভোলার নয়। তাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য এখনো শেকড় থেকে উৎসারিত হয়ে বিশ্বরূপে আবিভার্বের প্রেরণা পায়।


লেখক : গল্পকার ও সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৬/তারা

No comments:

Post a Comment