Saturday, 23 January 2016

Banglar Nayagra

দেখে এলাম বাংলার নায়াগ্রা

ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:23 Jan 2016   07:19:39 PM   Saturday   ||   Updated:23 Jan 2016   07:23:34 PM   Saturday
বাংলার নায়াগ্রা দেখার পথে অভিযাত্রী দল

বাংলার নায়াগ্রা দেখার পথে অভিযাত্রী দল

ফেরদৌস জামান : কোনো একদিন পুরনো পত্রিকার স্তুপ সরাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ আটকে যায় একটি ছবিতে। পত্রিকাটি ছয়-সাত বছর বা তারও আগের। দৃষ্টিনন্দন একটি বড় ছবির ঠিক নিচ থেকে গল্প বা কাহিনীর শুরু। গল্পটি তেমন জমজমাট না হলেও এর বিষয় ভীষণ আকর্ষণীয়। বিশেষ করে আমার কাছে, কারণ সেটি হলো রাইক্ষ্যং ঝিরি (ঝরনা)। গল্পে রাইক্ষ্যং ঝিরিকে ‘বাংলার নায়াগ্রা’ বলা হয়েছে। অবশেষে কয়েক বছর পর সেখানে গিয়েই বুঝেছি লেখক আবেগের কোন অবস্থান থেকে ঝিরিটিকে নায়াগ্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

সৌন্দর্যের বোধহয় একটা মাত্রা থাকা উচিৎ, অভিযাত্রীর অভিভূত মন যাতে অন্ততপক্ষে বর্ণনার ভাষায় ভেসে না যায় সেদিকটাতে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। নইলে সেই লেখা পড়ে যে কেউ প্রতারিত হতে পারেন। তবে আমরা প্রতারিত হইনি। যাই হোক, বহুদিন থেকেই সেখানে হানা দেয়ার পরিকল্পনা আঁটছিলাম। কিন্তু হয়ে উঠছিল না। এ তো আর কক্সবাজার বা পতেঙ্গা সৈকত নয় যে, চাইলাম আর এক রাতের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। বরং এর অবস্থান অত্যন্ত দূর্গম এলাকায়-পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার গভীরে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া এবং মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছাকাছি। সুতরাং অভিযানের জন্য দল গঠন ও আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো গুছিয়ে নিতে নিতেই পেরিয়ে যায় প্রায় এক বছর। অন্য সময়ের তুলনায় ভরা বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ভ্রমণ ঝুকিপূর্ণ। আর ঝরনা দর্শন তো তখন সম্পূর্ণ মানা। তার নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, পাহাড়ি ঢল। যা মুহূর্তেই প্রাণ হরণের কারণ হতে পারে। সেই ঢলে একবার পড়লে নিজেকে রক্ষা করার মত সামান্য সুযোগটুকুও মেলে না। অধিকন্তু রয়েছে ম্যালেরিয়ার প্রকপ ও জোঁকের উপদ্রপ। এ ছাড়াও লক্ষণীয় অন্য বিষয়টি হলো, এ সময় পাথর অত্যাধিক পিচ্ছিল হয়ে থাকে। বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে পিছলে পরে হাত-পা ভাঙার ঘটনাও প্রায়ই ঘটে। সমস্ত কিছু বিবেচনায় রেখেও ঝুঁকিটা নিয়ে নিলাম, তার প্রধান কারন রাইক্ষ্যং ঝিরির যৌবনটা দেখা।



অবশেষে আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ভরা বর্ষার এক রাতে আটজন মিলে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। যথারীতি ভোরে গিয়ে বাস থেকে নামলাম বান্দরবান টার্মিনালে। আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল চান্দের গাড়ি। এ পর্যায়ের পথ উপজেলা সদর প্রত্যন্ত রুমা পর্যন্ত। নদীর কিনারে ছোট্ট রুমা বাজার, সাজানো গোছানো প্রত্যেকটি দোকান। কি নেই সেখানে? চাল, ডাল, মশলাপাতি থেকে শুরু করে টেলিভিশন পর্যন্ত পাওয়া যায়। রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেই বাজারের পাশে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সেই কটেজটিতে, যেখানে এর আগে বেশ কয়েকবার থাকা হয়েছে। কিন্তু গিয়ে দেখি সদ্যই তা পরিত্যাক্ত হয়েছে। অবশেষে জায়গা মিলল কটেজের সাবেক তত্বাবধায়ক উ হা ফ্রু’র ঘরে। জানালা দিয়ে দেখা যায় আশপাশে পাহাড়ের শরীরের সাথে গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলো। নির্মাণশৈলী দেখে সহজেই বোঝা যায় কোনটি বাঙালি আর কোনটি পাহাড়িদের ঘর। উভয়ের ঘরবাড়ির গঠনের মধ্যে রয়েছে এক লক্ষণীয় পার্থক্য- পাহাড়িদের ঘর সাধারণত ভূমি থেকে খানিক উঁচুতে খুঁটির উপর স্থাপিত। নির্মাণে ব্যবহৃত হয় প্রধানত বাঁশ ও কাঠ। বাজারে রয়েছে বাঙালি ও পাহাড়ি স্বাদের আলাদা আলাদা রেস্তোরাঁ। আমরা বরং পাহাড়ি রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ করতে আগ্রহী হলাম। হলুদের ফুল আর বাঁশপ্রোল (বাঁশের কঁচি মুখ) এর তরকারী, সাথে জুম চালের গরম ভাত। পাহাড়ে গিয়ে পাহাড়ি খাবার খেয়ে রাতের ঘুম কারোরই মন্দ হল না।



রুমা পৌঁছার পর থেকে এক গাঁজাখোর পিছে লেগেছে, আমাদের গাইড হবে। অনেকভাবে বুঝানোর পরও সে বয়ান করতে থাকে তার বীরত্বগাথা, আখেরে অন্তত তাকে যদি গাইড হিসেবে নেয়া হয়। আরাম আয়েশে ঘুম থেকে উঠে সকালে ট্রেকিং শুরুর ইচ্ছা থাকলেও তার আতঙ্কে সংশোধিত পরিকল্পনা মাফিক ভোরেই ট্রেকিং শুরু করি মেন্দুই পাড়ার উদ্দেশ্যে। ঝিরি পথে দীর্ঘ ট্রেকিংয়ের পর পাক্কা আড়াই কি তিন ঘণ্টা উপর দিকে ওঠা পথ, অনেক কঠিন হলেও স্থানীয়দের সাথে পরামর্শ করে জানা যায় দিনের মধ্যে মেন্দুইপাড়া পৌঁছা সম্ভব। পথিমধ্যে সম্মুখ ও পেছন উভয় পাহাড়ের ওপর আকাশ হঠাৎ মেঘে ঢেকে আসে এবং দশ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি নামা শুরু হয়। মজার ব্যাপার হলো, দুই পাহাড়ে বর্ষণ চলমান অথচ, আমদের মাথার ওপর কটকটে রোদ। চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে বেলা দুইটার মধ্যে পেয়ে যাই মুড়ং জাতীর মেন্দুই পাড়া। পাড়ায় প্রবেশ করে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়ে তা হলো, বসতির দীর্ঘ উঠানে হেলানো গাছের ডগা থেকে একজন দ্রুত নেমে এসে সোল্লাসে কি যেন বলতে থাকে। যার অর্থ ‘কথা হয়েছে, কথা হয়েছে!’ অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কারও সাথে কথা বলতে তারা গাছের আগায় গিয়ে নেটওয়ার্কের আশায় প্রতিক্ষা করে। কয়েক মিনিট বাদে কোমর ব্যথায় কাতর একজন এসে ওষুধ কিছু চাইলে ভাট্টি রায়হান ও সেরাজুল শুরু করে দেয় ডাক্তারি, বিছিয়ে বসে দাতব্য চিকিৎসালয়। মলম, জাম্বাক প্যারাসিটামল ইত্যাদি বিতরণ করতে করতে পেরিয়ে যায় বেশ খানিকটা সময়। অবশেষে পরবর্তী পথের কথা চিন্তা করে ওদেরকে একরকম জোর করেই তুলতে হল।



এবার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত হয় দেড়-দুই ঘণ্টার মত এগুতে থাকব, মাঝে কোনো পাড়া পেলে সেখানেই থেকে যাব। ছায়াময় ঘন অরণ্য আচ্ছাদিত পাহাড়, উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে ২২০০ ফুট। পাহাড়ের শরীর বেয়ে নেমেছে সরু ট্রেইল। অনেক নিচ থেকে ভেসে আসছে খালের ছরছরিয়ে বয়ে যাওয়ার শব্দ। সেই শব্দের অদৃশ্য আকর্ষণে যতটা পারা যায় সকলেই দ্রুত নামছি। ওমনি কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘন মেঘে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে, সাথে প্রবল বর্ষণ। সামনে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়ে দ্রুত গিয়ে আশ্রয় নেই নিকটেই উঁচু জুম ঘরটায়। বৃষ্টির বেগ বেড়েই চললো। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় এক ঘণ্টা। আশপাশে কোনো বসতি নেই। সুতরাং, উপায়ন্ত না দেখে সেদিনের মত জুম ঘরটাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। ব্যাকপ্যাকে পরিমাণমত ডাল, লবণ, তেল, পেয়াজ ও স্যুপ মিক্স ছিল। সাথে মাঝাড়ি আকারের দুইটি পাতিলও নেয়া হয়েছিল। বিশেষ কায়দায় পলিথিন বিছিয়ে বৃষ্টি থেকে সংগ্রহ করা হল খাওয়ার পানি। বৃষ্টির পানি পেলেই জোঁকের উৎপাত বেড়ে যায়, তাই ঘর থেকে নামা কঠিন। বাঁশের খুঁটির উপর বেশ বড় মাচা, তার অর্ধেকটা জুরে জুমঘর এবং অবশিষ্ট অংশটুকু ফাঁকা- পাটি বিছিয়ে ফসল শুকানো জন্য। বৃষ্টি কমে গেলে ভাট্টি ও সুজিত লেগে যায় সবজি সংগ্রহ করতে। প্রতিটি জুমেই ধান বা অন্যান্য প্রধান ফসলের পাশাপাশি একাধিক প্রকারের সবজি বাগান থাকে। কোমরে রশি বেঁধে জুমের ঢালু খাদ থেকে ওলকচু, কচি ভ্ট্টুা, মরিচ সংগ্রহ করতে সক্ষম হলাম। ওদিকে মেহেদী দূরে কলা গাছ থেকে কয়েকটি ডাসা কাচকলা হাতে নিয়ে ফিরে এলো। সবকিছু পরিমাণ মত মিশিয়ে অদিত্য ও মেহেদীর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় রান্না হল এক ধরনের পাতলা ঝোল। তাতেই সেরে নেয়া  হল সেদিনের রাতের খাবার। ঘরের ভেতর চারজন আর বাইরের উন্মুক্ত মাচায় দুটি তাবু খাটিয়ে তার ভেতর শুয়ে পড়ল চারজন। জোঁকের আতঙ্কে ঘুম কি কারও আসে! যেন খুঁটি বেয়ে কিলবিল করে উঠে আসছে!

ঘুম সবে এসেছে, এর মধ্যে সকালও হয়ে গেছে। সহযাত্রীদের হৈ চৈ-এ ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বেরিয়ে দেখি ধীর গতির অলস মেঘ এসে অনবরত আমাদের ঘর ঢেকে ফেলছে। অমন দৃশ্য মেঘ-কুয়াশার শহর দার্জিলিংয়েও পাইনি। প্রায় এক ঘণ্টা মেঘের ভেতর আচ্ছন্ন থাকার পর ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে রওনা দিলাম। স্যাঁতস্যাঁতে কর্দমক্ত ট্রেইল ধরে নেমে উপস্থিত হলাম সেই মোহনীয় শব্দ ছড়ানো খালের পাশে। নাস্তা সেরেই উড়ন্ত পথ ধরলাম সমান তালে। পুনরায় আরোহণ করতে হল দেড়-দুই হাজার ফুট উঁচু পাহাড় শীর্ষে। দূরে উপত্যকার পর দৃষ্টি সীমায় ধরা দেয় দুমলং রেঞ্জ, যে রেঞ্জেরই দূরের এক প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেসরকারীভাবে দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘সাকাহাফং’। রেঞ্জের ঠিক পেছনেই আন্তর্জাতিক সীমানা। দীর্ঘ বিরতিতে অধিকাংশ সহযাত্রী ঘুমিয়ে পড়ল। রাইক্ষ্যং ঝিরির আগে সর্বশেষ বসতি ত্রিপুরা পাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। সে জন্য তো দু-একজনকে ঘুম থেকে ডেকেই তুলতে হল। পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা ত্রিপুরা জাতীর বসতি। থাকবার ব্যবস্থা হয় কারবারীর ভাগিনা অতিরামের ঘরে। ভীষণ সাধারণ মানুষ অতিরাম বাবু। পরবর্তীতে ওদিকটায় যতবার যাওয়া পড়েছে তার ঘরেই থাকা হয়েছে।



অতিরাম বাবুর সহযোগিতায় সহজেই একজন গাইডের ব্যবস্থা হয়ে যায়। পরের দিন সকালে ট্রেকিং শুরু করে পাহাড় শীর্ষে আরোহণের পর চোখে পরে প্যাঁচানো আকৃতির খাল। ভূ-তত্ব ও খনি বিদ্যার ছাত্র সহযাত্রী সৃজন ও স্বপনের কল্যাণে জানতে পাই, বিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের জল প্রবাহকে নাকি ‘অসবো লেক’ বলা হয়। সেই অসবো লেকই মাইলখানেক দূরে গিয়ে পতিত হয়েছে রাইক্ষ্যং ঝিরি নামে। বোধহয় দেড় ঘণ্টা পর নাগাল পেয়ে যাই প্রতিক্ষিত রাইক্ষ্যং ঝিরির। প্যাঁচানো খালটা এসে পরেছে বিশাল এক পাথরের বেসিনে। সেখান থেকে ৩-৪ ফুট খাড়া হয়ে বেশ কয়েক ধাপে অছাড় খেয়ে নিচে ঝরছে প্রায় দেড়শ ফুট প্রশস্ততায়। অতঃপর ত্রিশ ডিগ্রী কোণে দীর্ঘ গড়িয়ে পরছে অন্তত একশ মিটারের মত। সেখান থেকে সমতলে বেশ কিছু দূর এগিয়ে পুনরায় একই পরিমাণ ঢালু হয়ে গড়িয়ে পরছে আরও একশ মিটার। তারপর মিশেছে তুলনামূলক চওড়া এক প্রবাহের সাথে। তার আগে চলতি পথের বাম পাশটায় প্রতিনিয়ত ধাক্কা লেগে ধারণ করছে বিচিত্র সৌন্দর্য। অধিকন্তু দু-পাশের পাহাড় থেকে ছোট ছোট অনেক ঝরনা এসে অনায়াসেই মিশে যাচ্ছে ঝিরির বুকে। এক কথায় বলা যায় তার বর্ণনা করা সাধ্যের অতীত! সুতরাং, সে চেষ্টা না করাই শ্রেয়। তবে এতটুকু বলা যায় যে, কোনো শিল্পীকে বসিয়ে দিলে শিল্পী সত্তার পরিচয় ফুটিয়ে তোলায় সে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে দিনের পর দিন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জানুয়ারি ২০১৬/তারা

No comments:

Post a Comment