পাহাড় চূড়ায় পূর্ণিমার আলো
ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:28 Jan 2016 08:08:12 PM Thursday

দিনটি ছিল গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর, কোরবানি ঈদের এক বা দুই দিন পর। ঠিক তার পরের দিন ২৭ তারিখ রাতেই পূর্ণিমা। রাজধানীর কলাবাগান বাস কাউন্টার পাড়ায় গিয়ে দেখি শত শত মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই পর্যটক। ঈদের লম্বা ছুটিতে বন্ধুবান্ধব অথবা পরিবার পরিজন নিয়ে দু’চার দিনের জন্য বেরিয়ে পড়েছে। ভোরে বান্দরবান পৌঁছে দেখি আগে থেকেই হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমিয়েছে। তাদের সকলের উদ্দেশ্য বান্দরবানের প্রকৃতি কাছ থেকে দেখা। বছর পাঁচেক আগেও এমন পরিস্থিতি ছিল না। ভ্রমণ বলতে আমরা কেবল কক্সবাজার, সিলেট বিভাগ অথবা সুন্দরবন বেছে নিতাম। কারণ বিকল্প হিসেবে আজকের মত তখনও অন্য জায়গাগুলি তেমন প্রচারে আসেনি। সুতরাং, বর্তমানের চিত্র বেশ আলাদা।
উল্লেখিত পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন জায়গা। ক্রমেই অধিক পরিপক্ক হয়ে উঠছে পর্যটন খাতকে যুগ-উপযোগী করে তোলার শর্ত। পর্যটন যে একটি দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারে তা পার্শবতী দেশগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। সেই সম্ভাবনার দিক থেকে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। নেই কেবল পর্যটন বান্ধব উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা। এই যেমন সিঙ্গাপুরের দিকে তাকালে চোখে ধরা দেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চিত্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে তেমন কিছু নেই, অথচ মানুষের গড়া বিভিন্ন আয়োজন দিয়েই সাজিয়ে তোলা হয়েছে ছোট্ট দেশটি। ফলে পর্যটন ও শপিং-এর ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে সিঙ্গাপুরের স্থান বর্তমানে প্রথম সারিতে। সে তুলনায় আমাদের দেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। অধিকন্তু প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন বা স্থাপনা সমৃদ্ধ জায়গাগুলো তো রয়েছেই। এই সমস্ত কিছু কেন্দ্র করে আমরা বিশ্বের পর্যটন আকর্ষণে এক অনন্য স্থান অর্জন করে নিতে পারি। কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে চলছে দুই ঠুটো জগন্নাথ প্রতিষ্ঠান- পর্যটন করপোরেশন ও পর্যটন বোর্ড। আর তাদের মুরুব্বী হয়ে বসে আছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন, অপরিনামদর্শী সব পরিকল্পনা গ্রহণ, লোক দেখানো আর আকাশচুম্বি লক্ষমাত্রা নির্ধারণ এবং এসির হাওয়া খাওয়াই যাদের কাজ। শেখানোর মত দৃষ্টান্ত যেমন তারা স্থাপন করতে পারে না, তেমনি অন্যের কাছে শিখতেও জানে না। এত সব কিছুর ওপর দিয়ে গণতন্ত্রের পীঠস্থান আমাদের স্বধীন মাতৃভূমির রাজনীতি তো আশীর্বাদস্বরুপ (!), যে কারণে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে দেশের আর্থনীতিকে আমরা পর্যটন খাত থেকে শতভাগ বঞ্চিত হতে দেখেছি।
যাই হোক, ছোট্ট বান্দরবান শহরের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার পর্যটকে ঠাসা। জানতে পাই, থাকার জায়গা না পেয়ে অনেকেই স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় পর্যন্ত রাত কাটিয়েছেন। সময় বাঁচানোর স্বার্থে কোনো কিছুর অপেক্ষায় না থেকে পথেই ব্যবস্থা করে নেই ছোট্ট একটা পিক-আপ ভ্যান। ছাদ খোলা ভ্যানে সওয়ার করে সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ পৌনে দুই ঘণ্টায় পাড়ি দিতে সক্ষম হই। চেনা পথটাকে অচেনা লাগল। মাত্র কদিন আগেই বর্ষা শেষ হয়েছে। তার প্রভাব পাহাড়ের প্রকৃতিতে। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের দেয়াল ঝুঁকে চলে এসেছে সড়কের উপর। ভ্যান থেকে নেমে অপেক্ষায় থাকতে হল অন্য একটা দলের জন্য। কারণ ১২ জন না হলে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ মেলে না। সেই পরিস্থিতিতে যুক্ত হয় পুলিশ চেকপোস্টের বাড়তি আনুষ্ঠানিকতার উটকো ঝামেলা। সেখানেই পেরিয়ে যায় দুই ঘণ্টা। বাঁচানো সময়টা গোল্লায় চলে গেল! অন্য একটি দল পাওয়া গেলেও গাড়ি আমাদেরকে সম্পূর্ণ পথ নিয়ে যেতে পারল না। এগারো কি.মি. নামক বসতির আগে পাহাড়ের ওপর নামিয়ে দেয়া হল। সেখান থেকে পথের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রবল বর্ষণে সম্পূর্ণটা ধসে গেছে। সাথে ছিল দুই জন ইয়রোপীয় অভিযাত্রী। তাদের (বিদেশী) বেলায় পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ করার ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুন অনেক জটিল ও দীর্ঘ। সবকিছু মেনে নিয়েই তারা ছুটে এসেছে বাংলাদেশের প্রকৃতির টানে। পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল সম্বন্ধে আগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে বলল, ‘ইন্টারনেট ঘাটতে ঘটতে হঠাৎ একদিন বাংলাদেশের প্রকৃতি সম্বন্ধে জানতে পাই, তারপর পঠনপাঠন। অতঃপর কয়েক মাসের প্রস্তুতি শেষে রওনা করেছি তোমাদের দেশ দেখতে। ’
‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা...’ এবং আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের বেশ কয়েক লাইন সুরসমেত মুখস্ত করে নিয়েছে। আমাদের সাথে গলা মিলিয়ে গাইল, উচ্চারণ শুনে ও আবেগ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তারা সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার থেকে আসা।
দুই হাতে দুই লাঠির ওপর ভর করে নামার পর এগিয়ে গেলাম কমলাবাগান নামক জায়গাটা পর্যন্ত। সেখান থেকে পৌনে এক ঘণ্টা এগুলেই একটা উঁচু পাহাড়ের গোড়া। চলতি পথে পাহাড়ি কলা, পেঁপে, পেয়ারা পেয়ে আমাদের মত তারাও অনেক খুশি। বাকি পথের জন্য কয়েকটা করে পেয়ারা, কলা নেবে কি না জানতে চাওয়ার সাথে সাথে ব্যাগের মুখ খুলে ধরে বলল, ‘অবশ্যই নেব এবং অন্য কিছুর বদলে আজ এগুলোই খাব।’
ঢাকা থেকে বান্দরবানের পথে তারা অনেক কিছুই খেয়ে পরখ করে দেখেছে। সবচেয়ে বেশি মনে আছে খয়ের ও মিষ্টি জর্দা দিয়ে পানের কথা। বলেই হেসে ঠোঁট দেখিয়ে বলল, ‘দেখ এখনও কি দারুণ লাল হয়ে রয়েছে!’
পাহাড়ের ওপর সেনাক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে, তারপর পরবর্তী পথের দিকে এগিয়ে চলা। গোড়া থকে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করতে অতিক্রম করতে হবে ১৭০০ ফুট। রোদ ছিল বেশ তাই পানির মজুদটা ঠিকঠাক করে নিলাম, তার আগে ওদের দুজনকে বিদায় জানাতে হল কারণ আমাদের গন্তব্য সম্পূর্ণ আলাদা। পূর্ণিমা দেখতে আমাদের সবসমেত আরোহণ করতে হবে তিন হাজার ফুট ওপরে। কিছুক্ষণ উঠার পর দেখি, অন্তত প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর সামান্য ছায়া পেয়েই বসে পড়েছে একেকটি দল। ঈদের পর হওয়ায় অনেকেই পা বাড়িয়েছে পাহাড়ের দিকে, যাদের অনেকেরই পাহাড় ট্রেকিং-এর পূর্বাভিজ্ঞতা নেই। পানির মজুদ প্রায় সকলেরই শেষ। পানি চাইলে দু’একজনকে দিতেও হয়েছে। ইতিবাচক দিক হল, ইদানিং পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পাহাড়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের সংখ্যাই অধিক। সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে মাদ্রাসা শিক্ষকদের দলটিকে দেখে। আমরা যেখানে হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট পড়েই কুলাতে পারছি না। সেই পরিস্থিতিতে তারা পাঞ্জাবি-সালোয়ার ও টুপি-পাগড়ি পড়ে রওনা দিয়েছেন। আলাপ করে জানা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার রক্ষণশীলতা উপেক্ষা করে মাঝে মধ্যেই তারা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এবং শিক্ষার্থীদেরকেও ভ্রমণে উৎসাহিত করেন।
সেনাক্যাম্পে গিয়ে দেখি প্রায় একশ মানুষের ভিড়। কোনো কেনো দলের সদস্যদের গায়ে আবার একই রং ও নকশার গেঞ্জি- মাস্টার ট্র্যাকার, এক্সট্রিম ট্র্যাকার, মুসাফির ইত্যাদি নামের একেকটি দল। এন্ট্রি করতে যতটুকু সময় লাগল ততটুকুই, এরপর আমরা উঠতে লাগলাম উপরের দিকে। কাঙ্ক্ষিত বসতিতে পৌঁছার আগেই রাত হয়ে যায়। আগে পিছে কেউ নেই, গহীণ পাহাড়ি অরণ্যে কেবল মাত্র আমরা কজন। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসছে ঝিঝি পোকার শব্দ। তাতে যেন দুই কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ছোট্ট ঘরটায় ব্যাকপ্যাক রেখে পাশের বাড়িটাতে খাবার রান্না করতে বলি। চারদিকের দৃশ্য আমার দেখা পর্বত্য অন্য সব পাড়ার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর! তিন হাজার ফুট উঁচুতে হওয়ায় দৃষ্টি যতদূর যায় চোখে ধরা দেয় শুধু অসংখ্য পাহাড় চূড়া। সমস্ত পাহাড় পায়ের নিচে মনে হয়। সমস্ত প্রস্তুতি শেষে কাঠের বারান্দাটার সম্মুখে তাবু খাটানোর ব্যবস্থা করি। ঠিক তার বাম পাশে বিছানা বিছিয়ে যে যার মত অবস্থান নেই। কাঁসার থালার মতো জ্বলজ্বলে বিশেষ চাঁদটি যেন ক্রমেই চলে এল খুব কাছাকাছি। ছড়াতে থাকল রাশি রাশি মিষ্টি আলো। পাশ থেকে সহযাত্রী আলমগীর আলী শেখ এর কণ্ঠ থেকে মৃদু আবেগের শান্ত গলায় বেরিয়ে আসে পঙ্কজ উদাসের ‘চাঁদনী রাত মে চান্দকে সামনে, রূপসে পার্দা হাটা না গাজাব হো যায়ে...চান্দনী রাত মে...।’
http://www.risingbd.com/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9C-%E0%A6%9A%E0%A7%82%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A3%E0%A6%BF%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8B/144921
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৬/তারা
No comments:
Post a Comment