Tuesday, 26 January 2016

God living

ঈশ্বর ভদ্রপল্লীতেই থাকেন

শাহেদ হোসেন : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:26 Jan 2016   03:40:18 PM   Tuesday   
অট্টালিকার পেছনেই বস্তি

অট্টালিকার পেছনেই বস্তি

শাহেদ হোসেন : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে জেলেপাড়ার হতদরিদ্র মানুষের ওপর সমাজের তথাকথিত ‘ভদ্র’দের নিপীড়নের চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ মানিকের এই বিখ্যাত উপন্যাসটি প্রকাশের পর প্রায় ৮০ বছর কেটে গেছে। মাঝে ইংরেজ গেল, পাকিস্তানিরা গেল, বাংলাদেশের শাসকদেরও অনেক উত্থান-পতন ঘটলো। কিন্তু এ দেশের দুর্ভাগ্য, ঈশ্বর তার অবস্থান পরিবর্তন করেননি। এখনো তিনি ওই ‘ভদ্রপল্লীতেই’ বাস করছেন।

একটা সময় ছিলো যখন রাজনীতিকরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যেতেন। নির্বাচনে জেতার পর বেশিরভাগ সময় এলাকাতেই থাকতেন। আচার-বিচার, অভিযোগ, অনুযোগ সবই শুনতেন। নির্বাচনের আগে যেমন ‘ভাই’ থাকতেন, পরেও ভাই-ই থাকতেন। ভোটাররাও সময়ে-অসময়ে বুকভরা দাবি নিয়ে নেতাদের কাছে ছুটে যেতেন। সম্বোধনটাও ছিলো অনেক আদরের। যুগ পাল্টেছে, এনালগ থেকে ডিজিটালে প্রবেশ করেছি। এখন থ্রিজি পার হয়ে ফোরজিতে ভাসার চেষ্টা করছি। নেতাদের স্বভাব-চরিত্রেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। এখন ভোটের আগে ‘ভাই’ হলেও জিতলে হয়ে যান সাব (সাহেব)। এলাকায় পাঁচ বছরে কয়বার যান তারা, সেটা হয়তো কড়গুণে বলা যায়। তাদের চারপাশে ঘুরঘুর করা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। সেই সুবাদে দেশে কোটিপতির সংখ্যাও বেড়েছে। ব্যাংকে কোটি টাকা রাখেন, সরকারি হিসেবে নাকি এমন ব্যক্তির সংখ্যাই ১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ জন। গত পাঁচ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩৬ হাজার। স্বাধীনতার আগে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল ২২ পরিবারের হাতে। অর্থাৎ কোটিপতি বলতে ওই ২২ পরিবারকেই বোঝানো হতো। স্বাধীনতার পর মাত্র চার দশকে কোটিপতির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেল!
অনেকে হয়তো বলবেন, দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে। সবই সত্য। তবে ব্যবসাগুলি কোন পথে বেড়েছে, সৎ পথে কয়জন কোটিপতি হয়েছেন সেই প্রশ্নের উত্তরটা দেবে কে? এখন টাকা হলেই রাজনীতিতে নাম লেখানোর হিড়িক পড়ে। গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন বলা হয়েছিল, ২০০৯ সালে গঠিত নবম সংসদে সংসদ সদস্য হিসেবে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ ছিল ৬১.৩ শতাংশ। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বির্তকের শেষ নেই। এই সংসদে যে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য হয়ে দানছত্র খুলে বসেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নজির এখনো চোখে পড়েনি। বরং তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে তা দুর্নীতি দমন কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি। আবার এসব সংসদ সদস্যের আশেপাশে যারা ঘোরাঘুরি করেন তাদের সম্পদেরও পরিমাণ যে বেড়েছে তা দেখতে নিশ্চয়ই দূরবীনে চোখ রাখতে হবে না।

আগেই বলেছি, একটা সময় সাধারণ জনগণের প্রতি রাজনীতিকদের কিছুটা হলেও দায় ছিল। কালের রাস্তায় ঘষা খেতে খেতে হয়তো সেই দায়ের শুকতলীও খয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় এলে ভোটারের ডাক পড়ে। এবার তো অনেক জায়গায় সেই ডাকটুকুও পড়েনি। বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়ে গেছেন অনেকে। তাই ভোটারকে তারা বলতেই পারেন ‘তুই বেটা কোন কৃষ্ণ?’ সাংসদরা তাদের প্রাসাদেই থাকেন। মাঝে মাঝে সংসদে গিয়ে হাজিরাটা বহাল রাখেন। যারা উঠতি ধনী, তারা চলে যাচ্ছেন উত্তরা, গুলশান, ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকায়। ঢাকা মহানগরীর ‍দুর্ভোগ দেখতে হলে বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। অভিজাত ছাড়া অন্যান্য এলাকাগুলিতে গেলেই রাস্তা-ঘাটই আপনাকে উন্নয়নের সার্বিক চিত্র বলে দেবে। দুর্নীতি কমাতে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। তাতে এই রোগ কতটুকু কমেছে হয়তো টিআইবির প্রতিবেদনে শিগগিরই আমরা জানতে পারব। জঙ্গিবাদ জাতির কাঁধে সওয়ার হয়ে ঘুরছে। মন্ত্রী মহোদয় কাঁধে দৃষ্টি না দিয়ে সামনে বিরোধী দলকে খুঁজছেন। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজির ইতিহাস তো পুরনো হয়ে গেছে। সেই তালিকায় পুলিশের নামও মাঝে মাঝে চলে আসছে। পরিবেশ দূষণ নিয়ে অমৃত বাক্য বর্ষিত হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে দ্বিগুণ উৎসাহে পরিবেশের মুণ্ডুপাত চলছে।

আগে হয়তো ভদ্রপল্লীতে কাঁচুমাচু হয়ে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যেত। এখন ঈশ্বররা আরো দূরে সরে গেছেন। আমরা হরিজনরা ঈশ্বরের দর্শন পাওয়ার  দুঃসাহস দেখালে হয়তো ‘চোপ রাও’ শুনতে আর বেশিদিন লাগবে না।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জানুয়ারি ২০১৬/শাহেদ/তারা

No comments:

Post a Comment