বিশ্ব বাস্তবতা এবং আমরা
জাহাঙ্গীর আলম বকুল : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:22 Jan 2016 08:06:14 PM Friday || Updated:22 Jan 2016 08:47:19 PM Friday

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আল-কায়েদার, পাকিস্তান-আফগানিস্তানে তালেবানের আত্মঘাতী হামলা-হানাহানি এবং মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের নৃশংসতার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো সম্প্রদায়গত সংঘাত। যা আজ পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, লেবানন, এমনকি সৌদি আরবে মাথাচাড়া দিয়েছে। এসব দেশে একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের ওপর, আরেকজন মুসলিমের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালাচ্ছে শুধু সম্প্রদায় ভিন্ন হওয়ার কারণে। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এখন শুধু গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী দিনে তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ওলট-পালট করে দিতে পারে, তা রাষ্ট্রপ্রধানরা বুঝতে পারছেন। ইরান-ইরাক-সিরিয়া শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। সৌদি আরব সুন্নি প্রধান। তবে দেশটির মোট জনসংখ্যা ২০ শতাংশ শিয়া। এই শিয়াদের নেতা ছিলেন শেখ নিমর আল নিমর। সম্প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর তাতেই ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ইরাক, পাকিস্তানসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে শিয়া-সুন্নি সংঘাতে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। এরা সবাই মুসলিম। শুধু সম্প্রদায় ভিন্ন হওয়ার কারণে একে অপরকে হত্যা করছে। আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে আরেক মুসলিম ভাইয়ের রক্ত ঝরাচ্ছে। আরেক মুসলিমের মসজিদের হামলা চালাচ্ছে। এভাবে হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
মুসলিমের সংখ্যা বিচারে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। ইন্দোনেশিয়ার পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশের মুসলমানদের অধিকাংশ সুন্নি। তবে ক্ষুদ্র সংখ্যায় শিয়া রয়েছে। খুব ক্ষুদ্র অংশে রয়েছে কাদিয়ানি। কিন্তু এ দেশটি অনন্য নজির স্থাপন করেছে- শিয়া ও সুন্নি মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে। গত পঞ্চাশ বছরে শিয়া-সুন্নিকেন্দ্রিক একটা সংঘাতও ঘটেনি। কিন্তু এই সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্যদের হানা বেড়েছে। এবার গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে তারা নতুন আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা স্পর্শকাতর স্থানে হামলা চালাচ্ছে। বেশ কয়েক বছর জঙ্গিদের হামলা শুধু ব্লগার বা লেখকদের ওপর সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তারা যেন খোলস ছেড়ে বের হয়ে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। যা সরকারের সঙ্গে প্রতিটি সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষকে আতঙ্কিত করেছে।
গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া হামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে-
১. ২৪ অক্টোবর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে শিয়া মুসলিমদের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে দুইজনের মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থলে নিহত কিশোরটি সুন্নি সম্প্রদায়ের। আহত হয় কমপক্ষে ৫০ জন। বাংলাদেশে কোনো ধর্মীয় মিছিলে এটাই প্রথম হামলা।
২. ৩১ অক্টোবর রাজধানীতে পৃথক হামলা চালানো হয় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের এক প্রকাশকসহ তিনজনের ওপর। তাদের কুপিয়ে গুরুতর জখমের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অভিজিতের আরেক প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুষ্কৃতরা। গত একুশের গ্রন্থমেলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অভিজিৎ রায়কেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
৩. ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামে শিয়া মুসলিমদের আল মোস্তফা মসজিদে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত ও তিনজন আহত হন।
৪. ৪ ডিসেম্বর পর্যটন কেন্দ্র দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কান্তজিউর মন্দির প্রাঙ্গণে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলে দুর্বৃত্তের ছোড়া হাতবোমায় নয় ব্যক্তি আহত হন।
৫. ১০ ডিসেম্বর দিনাজপুরে একটি ইসকন মন্দিরে বোমা বিস্ফোরণ ও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইজন আহত হয়। হামলাকারী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। রাত ৮টার দিকে ওই হামলার সময় মন্দিরে ধর্মসভা চলছিল।
৬. ১৮ ডিসেম্বর জুম্মার নামাজের সময় চট্টগ্রামে নৌবাহিনী ঘাঁটি ঈশা খাঁর মসজিদে পরপর দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ছয়জন মুসল্লি আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে দুইজনকে আট করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, ...দুটি ককটেল (হাতবোমা) বিস্ফোরিত হয়েছে। এতে পাঁচ থেকে ছয়জন সামান্য আহত হন। কিন্তু কয়েকটি গণমাধ্যমে এটিকে ‘বোমা’ বলা হয়েছে। এ ঘটনায় দুইজন আটক এবং তাদের কাছ থেকে ১৪টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। আটক দুইজনকে সামরিক বাহিনীর সদস্য বলা হয়েছে। (দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫.)।
৭. ২৫ ডিসেম্বর জুম্মার নামাজের সময় রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের সৈয়দপুর চকপড়া আহমাদিয়া জামে (কাদিয়ানি) মসজিদে ‘আত্মঘাতী’ বোমার বিস্ফোরণে যুবক নিহত হয়। আহত হয় ১০ জন। ‘আত্মঘাতী বোমারু’ রাজশাহী পলিটেকনিকের ছাত্র বলে জানা গেছে।
বোমা হামলা এবং গুলি করা হয়েছে- কাদিয়ানিদের মসজিদে, শিয়াদের মসজিদে, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকার মসজিদে, মন্দিরে, মন্দির প্রাঙ্গনের মেলার যাত্রাদলের প্যান্ডেলে, শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে। প্রত্যেকটি হামলা ছিল ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট এলাকায় বা ব্যক্তিদের ওপর। এর অর্থ দাঁড়ায়-
১. যারা এটা করছে, তারা অথবা যারা এগুলো করাচ্ছে, তারা- একই সংগঠনের অথবা ভিন্ন সংগঠনের হলেও মতাদর্শ এবং উদ্দেশ্য অভিন্ন।
২. তারা এ দেশে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি (সেটা হিন্দু-মুসলিম বা শিয়া-সুন্নি) নষ্ট করতে চায়। এই সম্প্রীতি নষ্ট করে তারা সুদূর অথবা অদূর ভবিষ্যতে ‘লক্ষ্য’ বাস্তবায়ন করতে চায়। সেই লক্ষ্যটা হতে পারে- সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, ধর্মে-ধর্মে সংঘাত বাধিয়ে দিয়ে ইরাক, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো অস্থিতিশীল এবং ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়া।
৩. যারা হামলায় অংশ নিয়েছে, তারা এ দেশের মানুষ। (যারা আটক হয়েছে এবং যাদের হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে, তাদের দেখে)। এদের মগজধোলাই করে হামলা চালানোর উপযোগী করা হয়েছে। এদের কেউ কেউ আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে।
৪. এ হামলা চালাতে অথবা এদের সংগঠন পরিচালনার জন্য মোটা অংকের অর্থের যোগান পাচ্ছে। এই অর্থ দেশের ভেতর অথবা বাইরে থেকে আসছে।
অধিকাংশ হামলার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে একটি পর্যবেক্ষক ওয়েবসাইট দাবি করেছে। যদিও এই ওয়েবসাইটের ‘দাবির’ সত্যাসত্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এ দেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগের সত্যতা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
হামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে ঘুরে-ফিরে আসছে জেএমবির নাম। গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকার হাজারীবাগে পুলিশের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত জেএমবির সামরিক শাখার দুই কমান্ডার আব্দুল্লাহ এবং হিরণের বিরুদ্ধে আশুলিয়া এবং গাবতলীতে পুলিশ হত্যা এবং তাজিয়া মিছিলে হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হামলার ঘটনায় আটক এবং অভিযুক্তরা কোনো না কোনোভাবে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। এখন প্রশ্ন- জেএমবির সদস্যরা বা ওই মনোভাবাপন্ন যুবকের এসব হামলা কেন চালাচ্ছে? তারা অর্থ কোথা থেকে পাচ্ছে?
যারা এই হামলা করাচ্ছে- তারা কেন করাচ্ছে, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা আমার মতো অধিকাংশ মানুষের জানা নেই। তবে তারা যাদের দিয়ে করাচ্ছে- সেই সকল যুবকদের যে বিভ্রান্ত করে করানো হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মের কঠোর অনুশাসনের প্রতি আকৃষ্ট করে, ধর্মীয় বিভ্রান্তিতে মগজধোলাই করে এবং দারিদ্র্যকে কাজে লাগিয়ে তাদের আত্মঘাতী হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এদের অর্থের যোগানও নিরবচ্ছিন্ন থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও নির্মূল করা যাচ্ছে না। অতীতের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতেও যদি হামলা হয়, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।
আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ (থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে), মসজিদে-মন্দিরে হামলা, শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে, মিছিলে হামলা চালিয়ে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টির প্রাণান্তকর চেষ্টা চললেও আমার মতো অনেকে আশাবাদী এ দেশটাকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা ইরাক বানানো যাবে না। কারণ-
১. জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে কোনো সরকার, গোষ্ঠী উপেক্ষা করতে পারে না। এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসে গোড়া বা উগ্র নয়। তাদের সম্মিলিত চাওয়ার মুখে শায়খ রহমান, বাংলা ভাইদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। এই শক্তিই আমাদের মতো আশাবাদী মানুষের বড় ভরসা।
২. আবহমান কাল থেকে শিয়া-সুন্নি, হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের সহযোগিতায় পাশাপাশি বাস করে সম্প্রীতির যে বন্ধন তৈরি করেছে, তাতে চিড় ধরানো সহজ নয়। এই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কাছে পরাজিত হতে অশুভ শক্তি। বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে হামলার পর সেখানকার সুন্নি মুসলমানরা শিয়াদের সঙ্গে মিলে প্রতিরোধ গড়তে চেয়েছেন। হোসেনি দালানে যে কিশোর মারা গেছে, সে একজন সুন্নি মুসলিম। এ দেশের তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশ থাকে সুন্নিরা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জানুয়ারি ২০১৬/রফিক
No comments:
Post a Comment