Monday, 5 December 2016

Sonadia Island in Bangladesh

অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জেগে আছে সোনাদিয়া

রফিকুল ইসলাম মন্টু : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:06 Dec 2016   12:04:14 PM   Tuesday   ||   Updated:06 Dec 2016   12:12:17 PM   Tuesday
অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জেগে আছে সোনাদিয়া
রফিকুল ইসলাম মন্টু, কক্সবাজারের মহেশখালী ঘুরে : যে দ্বীপ এক সময় ছিল পাখির রাজ্য। যেখানে সবুজ বনানী আর নীল জলের মিলনমেলায় প্রকৃতি ফিরে পেত ভিন্ন রূপ। অযত্নঅবহেলায় সে দ্বীপ আজ সেকালের সব ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। সেখানে এখন পাখির দেখা খুব একটা মেলে না। ডিম ছাড়তে সমুদ্র থেকে আসা কচ্ছপের সংখ্যাও আগের চেয়ে অনেক কমেছে। লাল কাঁকড়ার তো দেখাই মেলে না। সোনা ফলানো দ্বীপের শত শত একর জমি পতিত পড়ে থাকছে। বন কেটে করা হয়েছে চিংড়ি ঘের।

তবুও দীর্ঘ সৈকতের অপার সৌন্দর্য্য আর প্রাণস্পন্দন নিয়ে সমুদ্র তীরে জেগে থাকে দ্বীপ। সূর্য্য ডুবছে প্রকৃতির নিয়মে। ভোরের আলো ফুটে পুব আকাশে উদিত হচ্ছে নতুন সূর্য্য। অবারিত সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয় নতুন এক একটি দিনের।

সমুদ্র তীরের জেলা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের অবস্থা এমনই। এখানে আছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, আছে অপার সম্ভাবনা। এত সম্ভাবনা থাকার পরেও এখানকার মানুষের সংকটের শেষ নেই। সরকারের উর্ধ্বতন মহলের নজরদারির অভাবে সব সম্ভাবনা হারাতে বসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই এলাকার উন্নয়নে ও সম্ভাবনা বিকাশে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।   

দেশ-বিদেশে নাম ছড়ানো দ্বীপ সোনাদিয়া কীভাবে বদলে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের নানান অভিযোগ। আগের সোনাদিয়ার সঙ্গে এখনকার সোনাদিয়ার তুলনা করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা বললেন, এই সংরক্ষিত বনে বিপুল পরিমাণ বন ছিল। বনে বসতো হাজারো পাখি। শীতে অতিথি পাখির দেখা মিলত প্রচুর পরিমাণে। সেই বন উজাড় হয়ে এখন চিংড়ি ঘেরে পরিণত হয়েছে। এতে আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া সম্ভব হলেও পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে।

সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শচিরাম দাস বলেন, এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় পর্যটকদের আসা-যাওয়ায় সমস্যার অন্ত নেই। মহেশখালী উপজেলা সদর গোরকঘাটা থেকে ঘটিভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ কোনভাবে আসা সম্ভব হলেও এর পরের অংশে চার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সোনাদিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোটা সবার পক্ষেই দু:সাধ্য। এইটুকু পথে তিনটি নদী। দু’টিতে বড় পাকা ব্রিজ থাকলেও রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। একটি নদীতে আছে নড়বড়ে সাঁকো। 

দ্বীপের বর্গাচাষি মোবারক হোসেন বলেন, এখানে সম্ভাবনার শেষ নেই। এখানকার জমি সব ধরণের ফসলের জন্য উপযোগী। অথচ উদ্যোগের অভাবে দ্বীপে বহু জমি পতিত পড়ে থাকছে। এই উর্বর জমিতে কৃষি প্রকল্প নিয়ে সরকার লাভবান হতে পারে; সেইসঙ্গে লাভবান হবে চাষি।
Sonadia_Somvabona

দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, এক সময় এখানকার সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক, লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ ছিল প্রচুর পরিমাণে। এখন সেগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। দ্বীপের বাসিন্দারা সেসব এখন আর তেমনটা দেখতে পান না। কচ্ছপের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে সমুদ্রে অবমুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে দ্বীপের সৈকতে কয়েকটি হ্যাচারি স্থাপিত হলেও সৈকতে কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। ডিসেম্বরে দু’টি কচ্ছপ থেকে মাত্র ২৪৬টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানালেন দ্বীপের পূর্বপাড়ায়  হ্যাচারির দায়িত্বে থাকা আলী আহমেদ।   

সমুদ্র আর নদী ঘেরা জনপদ মহেশখালী উপজেলা সদর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে কুতুবজোম ইউনিয়নের আওতাভূক্ত দ্বীপ সোনাদিয়া। গোটা দ্বীপটি ইউনিয়নর ২ নম্বর ওয়ার্ডের অওতায়। সোনাদিয়ার মোট জমির পরিমাণ ২৯৬৫ দশমিক ৩৫ একর। ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমাণ  ৩ দশমিক ১৫ একর। শুঁটকি মহাল ২টি, চিংড়ি চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৯৮ একর। বন বিভাগের জমির পরিমাণ ২১০০ একর। বাকি সব প্রাকৃতিক বনায়ণ ও বালুময় চরাঞ্চল।

দ্বীপের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি বলে দাবি চরের অনেকেরই। আগে এখানকার সমস্যার সমাধান করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলেই সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। অনেক চেষ্টা করেও দ্বীপের উন্নয়ন সেভাবে এগিয়ে নিতে পারছেন না বলে বলে জানালেন সোনাদিয়ার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। তাদের দাবি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে দ্বীপবাসীর জীবনধারায় পরিবর্তন আসবে। শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়বে। তখন দ্বীপের মানুষেরা নিজেরাই দ্বীপ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেবে। 

সূত্র বলছে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সমৃদ্ধ সোনাদিয়ায় রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত বিশেষ ধরণের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্যারাবন, দূষণ ও কোলাহল মুক্ত সৈকত। এখানে লাল কাঁকড়া, কচ্ছপের শেষ চিহ্ন এখনও দেখার সুযোগ আছে। দ্বীপের পূর্বদিকে নতুন জেগে উঠা চরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে। দ্বীপবাসীর নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাদাসিধে জীবন যাপন, হযরত মারহা আউলিয়ার মাজার ও তার আদি ইতিহাস, জেলেদের সাগরের মাছ ধরার দৃশ্য, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, প্যারাবন বেষ্টিত আঁকা-বাঁকা নদীপথে নৌকা  ভ্রমণ পর্যটকদের ভ্রমণের পিপাসা মিটাবে নি:সন্দেহে।

সোনাদিয়া দ্বীপের অধিকাংশ মানুষের পেশা সমুদ্রে মাছধরা। কিছু পরিবার চিংড়ি ও লবণ উৎপাদনে জড়িত। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অত্যন্ত পরিশ্রমী। পুরুষেরা সমুদ্রে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে আর নারীরা সে মাছ বাজারজাতকরণের কাজে সক্রিয় অংশ নেন। মাছ শুকানো ও গুদামজাত প্রক্রিয়া তো বলতে গেলে নারী ও শিশুরাই করে থাকে। এমনিতেই দেশব্যাপী সোনাদিয়ার সামুদ্রিক মাছের কদর খুব বেশি। বিশেষ করে শীত মৌসুমে তৈরি হয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকি। কক্সবাজারে পর্যটনে আসা বহু পর্যটক সোনাদিয়ার শুঁটকির লোভ সামলাতে পারেন না।

সোনাদিয়ার দ্বীপের নামকরণের সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে জনশ্রুতি আছে, এককালে চট্টগ্রামের বাশঁখালী হতে কিছু জেলে অস্থায়ীভাবে সোনাদিয়ার মাছ শিকারে আসতেন। একজন জেলে সমুদ্রে জাল ফেলার পর জালে শিলাখন্ড দেখতে পান। এটি তার কাছে খুবই আর্কষনীয় এবং মূল্যবান মনে হয়। শিলাখন্ডটি নিয়ে ঘরের দরজা সম্মুখে পা ধোয়ায় সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার শুরু করেন। কিছুদিন পর জেলেটি পাথরের শিলখন্ডটি দায়ের শান দিতে গেলে বুঝতে পারেন আসলে সেটি একটি স্বর্ণখন্ড। এ ঘটনার কারণে দ্বীপের নাম ‘সোনাদিয়া’ হয়েছে বলেও শতবর্ষী ব্যক্তিদের মুখে শোনা যায়।
Sonadia_Somvabona

যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ দ্বীপে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেই। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হলে বিশ্বব্যাপী পর্যটনকেন্দ্র রাজধানী হিসাবে পরিচিত কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারে সোনাদিয়া। কারণ, কক্সবাজার সৈকত থেকে অতি সহজেই যাওয়ার সুযোগ রয়েছে সোনাদিয়া দ্বীপে। এই উদ্যোগ কক্সবাজারের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি দ্বীপবাসীর জন্য বিকল্প আয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে।

সোনাদিয়া দ্বীপ বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা। দ্বীপে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে ইকোট্যুারিজমের উন্নয়ন ঘটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দ্বীপবাসীর সম্পৃক্ততায় কমিউনিটি ভিত্তিক ইকোট্যুারিজমের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যা দ্বীপবাসীর বিকল্প আয়ের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।

সোনাদিয়ার উন্নয়ন, সম্ভাবনার বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষা প্রসঙ্গে কুতুবজোম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন খোকন বলেন, এখানকার সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখেই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অচিরেই সোনাদিয়া ফিরবে অন্যরূপে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ নভেম্বর ২০১৬/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু

No comments:

Post a Comment