Wednesday, 7 December 2016

A Greatman Shawkat Osman info

কাপুরুষের মতো মরব না: কথা রেখেছিলেন শওকাত

রফিকুল ইসলাম কামাল : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:08 Dec 2016   07:59:38 AM   Thursday   ||   Updated:08 Dec 2016   09:46:04 AM   Thursday
শওকাত নাওয়াজসহ অন্যদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার

শওকাত নাওয়াজসহ অন্যদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার

রফিকুল ইসলাম কামাল, সিলেট : ‘যদি আমরা বেঁচে থাকি তবে দেখা হবে। আর দেশের জন্য যদি প্রাণ হারাই, তার জন্য দুঃখ নাই। তবে ভীরু কাপুরুষের মতো মরব না। আমরা এখান থেকে যতদূর সাধ্য দেশের কাজ করে যাব।’

মার্চ, ১৯৭১। উত্তাল সময়। লাল-সবুজের বাংলার বুকে পাক হায়েনাদের ছোবল চলছে। অকাতরে প্রাণ দিচ্ছেন মানুষ। বাতাসে লাশের গন্ধ। মুক্তির নেশায় পাগলপ্রায় বাঙালি।

ঠিক ওই সময় নিজের বোনের কাছে চিঠি লিখলেন শওকাত নাওয়াজ। সিলেটের মালনিছড়া (মালনিচেরা নামেও পরিচিত) চা বাগানের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার শওকাত নাওয়াজ আবেগঘন ভাষায় চিঠিতে ওই ‘যদি আমরা বেঁচে থাকি.....কাজ করে যাব’ কথাগুলো লেখেন।

শওকাত নাওয়াজ নিজের কথা রেখেছিলেন। ভীরু কাপুরুষের মতো নয়, গ্রহণ করেছিলেন বীরের মৃত্যু।

মালনিছড়া চা বাগান ১৮৫৪ সালে স্থাপিত। বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান হিসেবে এটি স্বীকৃত। সিলেট শহর থেকে বেরিয়ে ওসমানী বিমানবন্দর যাওয়ার সুনির্মল পথের পাশেই বিশাল এই চা বাগান। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল এ বাগানে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী। সেই গণহত্যায় শহীদদের সঙ্গে ছিলেন শওকাত নাওয়াজ।
Sylhet-Malnichora
গণহত্যা বিষয়ে কথা বলছেন দশরত দাস

কদিন আগে পড়ন্ত বিকেলে এ প্রতিবেদক মালনিছড়া চা বাগানে যান। বাগানের সর্দার লক্ষিন্দর বাবু ঘুরিয়ে দেখান গণহত্যার স্থান। সঙ্গে ছিলেন বাগানের আরো দুই ব্যক্তি। যাদের একজন দশরত দাস, অন্যজন গৌরাঙ্গ দাস।

লক্ষিন্দর বাবু বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৮-১০ বছরের মতো। যুদ্ধ শুরুর পরপরই মালনিছড়া চা বাগানে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে থাকে ঘরবাড়ি। ভয় আর আতঙ্কে প্রাণ নিয়ে পালাতে থাকেন বাগানে বসবাসকারী সবাই। একপর্যায়ে সবাই একত্রিত হন বাগানের বড় বাবুর বাংলোয়।’

কে এই ‘বড় বাবু’ এমন প্রশ্নে লক্ষিন্দর বলেন, ‘আমরা আমাদের বাগানের ম্যানেজারকে বড় বাবু বলে ডাকি। তখন ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন শওকাত নাওয়াজ বাবু।’

বলে চলেন লক্ষিন্দর বাবু, ‘সবাইকে বড় বাবু বাগান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলেন। বাগানের শ্রমিকরা তাকেও (শওকাত) বাগান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার তাগাদা দেন। কিন্তু তিনি পালাতে চাননি। চেয়েছিলেন কোনভাবে দেশের জন্য কিছু করতে। কিন্তু তার আগেই পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন।’

মুক্তিযুদ্ধের পর বাবা, চাচাদের কাছ থেকে এসব শুনেছেন লক্ষিন্দর বাবু। একই রকম তথ্য জানালেন দশরত দাস আর গৌরাঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের বয়স ১২ বছর ছিল বলে জানান দশরত। আর গৌরাঙ্গের বয়স ছিল ১০-১১ বছর।
Sylhet-Malnichora
এ বাংলোতেই অবস্থান করছিলেন শওকাত

একাত্তরের ৬ এপ্রিল মালনিছড়ায় ঘনিয়ে আসে পাকিস্তানিদের বর্বরতার অন্ধকার। মালনিছড়া চা বাগানের বাংলোয় অবস্থান করছিলেন ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার শওকাত নাওয়াজ, তার অনুজ শাহ নাওয়াজ, তার দুই বন্ধু মেজবাহ উদ্দিন ও আবদুল কাদের। এদের বাইরে বাগানের আরো ছয় কর্মচারী ছিলেন সেখানে।

সেদিন বিকেল। আচমকা বাংলো ঘিরে ফেলে পাক হানাদার বাহিনী। বাংলোর সিঁড়িতেই গুলি করে হত্যা করা শওকাত নাওয়াজকে। বাকিদের ধরে এনে বাংলোর অদূরে একটি চালতা গাছের নিচে এক সারিতে দাঁড় করানো হয়। এরপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে বর্বরতম গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী।

মালনিছড়া চা বাগানের সর্দার লক্ষিন্দর, বাগানের শ্রমিক দশরত দাসও বলেন, ‘যুদ্ধের সময়টাতে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়িয়েছি বাবা-চাচাদের সঙ্গে। যুদ্ধের কিছুদিন পরে আমরা বাগানে ফিরে আসি। তখন চালতা গাছের নিচে শহীদদের কঙ্কাল মাটিচাপা দেওয়া হয়। আর বাংলোর সিঁড়ি থেকে শওকাত নাওয়াজের লাশের কঙ্কাল তার বাবা তুলে এনে চা বাগানের এক টিলার পাদদেশে সৎকার করেন।’

ওই টিলার পাদদেশে মালনিছড়ায় শহীদদের স্মরণে বাগান কর্তৃপক্ষ একটি ছোট আকারের শহীদ মিনার তৈরি করেছেন। সাদা রংয়ের সে মিনারে প্রতিবছর বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বাগানের বাসিন্দারা। তবে যে চাতাল গাছের নিচে শাহ নাওয়াজ, মেজবাহ উদ্দিন ও আবদুল কাদেরসহ নয়জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, সে স্থান পড়ে আছে অবহেলায়। সংরক্ষণে এখনও নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।

চা বাগানের বাসিন্দারা জানালেন, এ গণকবর মালনিছড়া ও লাক্কাতুড়া চা বাগানের মধ্যবর্তী স্থানে পড়েছে। তাই উভয় বাগান কর্তৃপক্ষের কেউই জায়গাটি সংরক্ষণে এগিয়ে আসছেন না। আর বাগানের ব্যক্তিগত মালিকানা থাকায় প্রশাসনও কিছু করছে না।

এ বিষয়ে কথা হয় সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভবতোষ বর্মণ রায় রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মালনিছড়াসহ সিলেটের সব গণকবর সংরক্ষণ করা অবশ্যই কর্তব্য। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বার বার আহ্বান জানিয়েছি। আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা না থাকলে আমরা নিজেরাই এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতাম।’

এ ব্যাপারে আবারও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন ভবতোষ বর্মণ।


রাইজিংবিডি/সিলেট/৮ ডিসেম্বর ২০১৬/কামাল/রিশিত

No comments:

Post a Comment