Saturday, 3 December 2016

History and responsibility

প্রসঙ্গ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : দায়িত্ববোধে আমরাই পিছিয়ে

হাসান মাহামুদ : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:03 Dec 2016   09:07:01 PM   Saturday   ||   Updated:03 Dec 2016   10:36:20 PM   Saturday

হাসান মাহামুদ : জেরুজালেম ইসরায়েলের মানবিক ইতিহাসে সবচেয়ে অন্যতম সংগ্রামী ও প্রাচীন শহর। দুমাস আগে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদকে ‘মুসলমানদের পবিত্র স্থান’ বলে ঘোষণা করেছে।

এ ঘোষণার কারণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির জন্য সহায়তার পথ প্রশস্ত হবে বলে অনেকেই আশা করছেন। কিন্তু বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না ইসরায়েল। এমনকি এই স্বীকৃতির কারণে ইউনেস্কোর সাথে সম্পর্ক ছিন্নও করেছে তারা।

বহু বছর ধরেই মুসলমানদের পবিত্র আল আকসা মসজিদ ও বায়তুল মুকাদ্দাস শহরের মালিকানা নিয়ে নানা বিতর্ক চলছিল। জাতিসংঘ ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে-থাকা এ অঞ্চলটিকে অধিকৃত অঞ্চল বলে মনে করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ অঞ্চল থেকে ইসরাইলকে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্তে ফিরে যেতে বলেছে বহু বছর আগেই। অথচ বর্ণবাদী ইসরাইল চায় বায়তুল মুকাদ্দাস শহরটিকে কথিত ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। অন্যদিকে আল-আকসা মসজিদ তথা মুসলমানদের প্রথম কিবলার শহর বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্বাঞ্চলকে ফিরে পেতে চায় ফিলিস্তিনিরা এবং তারা এ অঞ্চলকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করতে চায়।

যদিও ইসরাইল জাতিসংঘের নতুন মহাসচিবের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রতিক এই ইশতেহারকে অকার্যকর করতে চাইছে। কিন্তু ন্যায়কামী বিশ্ব-জনমত আশা করছে ইউনেস্কো তার স্বীকৃতি বা ইশতেহারটি বাস্তবায়ন করে ফিলিস্তিনে সংস্থাটির অতীতের নানা ভুলের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেবে। বাকিটা আমরা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম আশাবাদীর চোখে।

২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বাউল গানকে মানবতার ধারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। সারা বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাউল গানকে বিশ্ব মানবতার ঐতিহ্যের ধারক বলে ঘোষণা দিয়েছিল ‘অসাধারণ সৃষ্টি’ বলে আখ্যা দিয়ে। এরপর বাউল গান নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়।

বাউল গান এ দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকায়ত সংগীতের একটি বিশিষ্ট ধারা, বাউল সম্প্রদায়ের নিজস্ব সাধনগীত। বাঙালি জীবনাদর্শন এবং সংস্কৃতির যে বিকাশ কালে কালে হয়েছে, তারই দেখা মেলে বাউল গানে ও বাউল জীবনাদর্শনে। বাংলার উন্মুক্ত আকাশ, চিরসবুজ প্রান্তর, পাখির কাকলি, নদ-নদীর প্রবাহ, সোনা ফলানো মাটি আর মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা বাউল গানে একাত্ম হয়ে ফুটে ওঠে। আর ফুটে ওঠে সাম্যের কথা, মানবতার কথা। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, এখন সারা বিশ্বে মানবতা নিয়ে যে উন্মাদনা, তার ভিত্তি ছিল এ বাংলাদেশে হাজার বছর আগে। বর্তমানে যে কল্যাণকর, অর্থনীতির জয়ঢাক সারা বিশ্বে বাজানো হচ্ছে, তারও ভিত্তি ভূমি ছিল এ বাংলাদেশের পুন্ড্রনগরে- প্রায় দুহাজার বছর আগে।

বাউল গানকে বিশ্বমানবতার ধারক হিসেবে যে স্বীকৃতি ইউনেস্কো দিয়েছে, তা বাউল গানের যোগ্য প্রাপ্তি। এর মাধ্যমে উপরের বিষয়গুলো আনুষ্ঠানিকভাবেই যেন বিশ্ববাসীর কাছে উঠে আসে। এ স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য বিরাট গর্বের। তবে এ স্বীকৃতির সঙ্গে বিরাট দায়িত্বও বর্তায়। এ স্বীকৃতি প্রাপ্তির ১১ বছরের অধিককাল পেরিয়ে গেলেও তেমন কাজ হয়নি।

দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাউল গান সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সব গান অডিও, ভিডিও ও সিডিতে সংরক্ষণ করা আমাদের উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা করিনি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের বাউল গান যে বিশ্বমানবতার ধারক হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছিল, অনেকে তা জানেনই না। না জানার দুটি যৌক্তিক কারণ হতে পারে- সরকারের প্রচারণার অভাব এবং তথাকথিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে বিজাতীয় সুর ও সংগীতের অনাহুত অনুপ্রবেশের ধাক্কা।

কিন্তু জাতীয় সম্পদ বিবেচনায় এবং স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আমাদের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল বাউল গান সংরক্ষণে। বাউল গানের বিকাশে বেশির ভাগ কৃতিত্ব লালন সাঁইয়ের। লালন সাঁইকেও তো ভুলে বসে আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ও নাট্যকলা বিভাগ এবং বাংলা একাডেমির লোকসাহিত্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে বাউল সংগীত সংরক্ষণে। বাউল সংগীত শিল্পী ও বাউল গবেষকদেরও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। বাউল গান বিভিন্ন ভাষায় ভাষান্তর করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

পৃথিবীর বুকে এমন কোনো ইতিহাস নেই, কোনো জাতি তার ভাষার জন্য লড়েছে, প্রাণ দিয়েছে, রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। মাতৃভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারের জন্য একমাত্র আমরাই জাতিগতভাবে সংগ্রাম করেছি। অর্ধশতাব্দী ধরে প্রাণের আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমরা মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করছি। আজ এই উদযাপন দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পৃথিবীতে একমাত্র আমাদের ভাষার দিবস সারাবিশ্বে পালিত হয়। ভাবুন, কত বড় গর্বের বিষয় এটি!

এই মাতৃভাষাকে নিয়ে কাজ করার জন্য দেশে স্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। মাতৃভাষা নিয়ে কাজ করার জন্য এমন মানের অন্য একটি ইনস্টিটিউট বিশ্বে আর নেই। গৌরবের বিষয় হচ্ছে, এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটও গত বছরের নভেম্বরে ইউনেস্কোর ক্যাটাগরি-২ ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এটি একটি অনন্য অর্জন, ভাষা এবং ভাষা নিয়ে কাজ করা সংস্থার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশের রয়েছে।

একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, যে কোনো ধরনের স্বীকৃতি সবসময় দায় এবং দায়িত্ববোধ দুটোই বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, রাজনৈতিক জটিলতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, আইনগত দিক দিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজের ধীরতা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার ফলে আমরা দেখেছি এই ইনস্টিটিউট পুরো দমে চালু করতে সরকারের দশ বছরের বেশি সময় লেগেছিল। এমনকি এখনো এই ইনস্টিটিউট কোনো আন্তর্জাতিকমানের গবেষণা প্রকাশ করতে পারেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইদানিং নিজস্ব কিছু আলোচনা অনুষ্ঠান পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে আয়োজন করে। এ ছাড়া সারা বছর এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো কার্যক্রম থাকে না। এমনকি অপূর্ব সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর এই ভবন এবং এর সিঁড়িতেও জমে থাকে ময়লার আস্তর। অথচ ২২টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। রয়েছে ভাষা জাদুঘরও।

২০১৩ সালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। সংস্থাটির আওতাধীন ‘বিশ্বসভ্যতার স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় স্থান পায় আমাদের এই ঐতিহ্যমণ্ডিত পণ্যটি। কিন্তু সরকারিভাবে জামদানির বিকাশ এবং প্রচারণায় কোনো কাজই করিনি। এমনকি যে পণ্যটি তিন বছর আগেই ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছিল, তাকে গত মাসে দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন সনদ দিয়েছি আমরা। তাও আবার প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে। অর্থ্যাৎ, আমাদের আর কোনো ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নেই।

আমরা অহঙ্কার করি ইলিশ মাছ নিয়ে। এই মাছও কিন্তু আমাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নয়। সর্বশেষ গত সপ্তাহে বাংলা বর্ষবরণের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’-কে মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। অথচ এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের জাতীয় ঐহিত্যবাহী জিনিসের তালিকায় নেই। আসলে তালিকায় নেই বললে ভুল হবে। কারণ আমরা মনে করতে পারি, অবশ্যই এটি আমাদের ঐতিহ্যবাহী জিনিস, চিরাচরিত উৎসবের অংশ। তালিকায় নেই বললে, অনেকে এটি নিয়ে তর্কও করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের কোনো ‘ন্যাশনাল ইনভেন্টরি’ই নেই। অর্থ্যাৎ তালিকাই নেই। তালিকা যদি না থাকে, তালিকায় নাম থাকবে কীভাবে?

আমাদের এই দৈন্যতার কথা এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে গেছে যে, আমাদের ন্যাশনাল ইনভেন্টরি নেই। ইউনেস্কোও বাংলাদেশের এই  সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, নিজেদের ঐতিহ্যবাহী উপাদানগুলোকে আগে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিতে হবে। সে লক্ষ্যে একটি ন্যাশনাল ইনভেন্টরি বা জাতীয় পরিসংখ্যানপত্র তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এমনকি সংস্থাটির পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, ‘সামান্য এই কাজ সম্পন্ন করা গেলে পাইপ লাইনে থাকা আরো কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অর্জন করতে পারবে’।

শুধুমাত্র এসব কারণেই আমাদের বাংলাদেশের মৌলিক সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী অংশ নকশীকাঁথা এবং যাত্রাপালা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়নি।

ইউনেস্কোর দায়িত্ব হচ্ছে সহিষ্ণুতা ও ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধার প্রসার ঘটানো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজের অসংখ্য উপাদান। সংশ্লিষ্ট দেশের আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব উপাদান যাচাই-বাছাই ও সুনির্দিষ্ট করে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তুলে ধরার কাজ করছে ইউনেস্কো। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির স্বীকৃতি লাভের মধ্যদিয়ে একটি দেশ ওই উপাদানের আঁতুড়ঘর হিসেবে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপিত হয়। মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু শুধু স্বীকৃতি পেয়ে খুশি হয়ে বসে থাকলে চলে না। বাউল গানের স্বীকৃতি পেয়েছি আমরা ১১ বছর আগে। কিন্তু বাউল গান নিয়ে সরকারের আগ্রহ এবং কর্মসূচি সর্ম্পকে আমরা খুব বেশি দেখিনি।

আর নিজের দেশেই যদি গুণীর কদর না করা হয়, ঐতিহ্যের স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তাহলে বিশ্ব দরবারে তা মাথা তুলে কিভাবে দাঁড়াবে? ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর পাঁচটি শর্ত পূরণ করা বাধ্যতামূলক। অন্যতম প্রধান শর্ত-যে দেশের উপাদান সে দেশকে ওই উপাদানের স্বীকৃতি দিতে হবে আগে। প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, উপাদানটি ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে ওই দেশে স্বীকৃত। আর এ জন্য সে দেশের একটি ন্যাশনাল ইনভেন্টরি বা জাতীয় পরিসংখ্যানপত্র থাকতে হবে।

এ জায়গাটিতে এখনও কাজ বাকি আছে বাংলাদেশের। পূর্ণাঙ্গ ন্যাশনাল ইনভেন্টরি তৈরি হয়নি। ন্যাশনাল ইনভেন্টরি না থাকায় এবং দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ আবেদন ফাইলের কারণে গত দুই বছর বাংলাদেশর অর্জন ছিল শূন্য। জাতীয় স্বার্থে হলেও আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যগুলোর দিকে তাকানো উচিত। একটি ন্যাশনাল ইনভেন্টরি করা উচিত। আগের দেশের ঐতিহ্যকে দেশে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাহলে বিশ্বজয়েও আমাদের সময় লাগবে না।

লেখক : সাংবাদিক।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ডিসেম্বর ২০১৬/হাসান মাহামুদ/সাইফ

No comments:

Post a Comment