জয়া থেকে আম্মা
রাসেল পারভেজ : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:06 Dec 2016 10:04:14 AM Tuesday || Updated:06 Dec 2016 11:13:59 AM Tuesday

জয়রাম জয়ললিতা
স্থানীয় সময় সোমবার দিবাগত রাত ১১টা ৩০ মিনিটে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
তামিলনাড়ু রাজ্যের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার জীবন নাটকীয়তায় পূর্ণ। রুপালি পর্দার তারকা থেকে হয়েছেন জনপ্রিয় রাজনীতিক, মুখ্যমন্ত্রী। তামিলদের মধ্যে তিনি আম্মা নামে পরিচিত। মৃত্যুর পর দলীয় বিবৃতিতে তাকে ‘লৌহমানবী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো।
২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮
এই দিনে কর্ণাটকের মেলকোটে (তৎকালীন মহীশূরে) জন্মগ্রহণ করেন জয়ললিতা। বাবা-মা যথাক্রমে জয়রাম ও বেদাবাল্লি। বংশের রেওয়াজ অনুযায়ী দাদির নামে তার নাম রাখা হয় কমলাবাল্লি। তার বয়স যখন এক বছর, তখন তার নাম দেওয়া হয় জয়ললিতা। তার দাদা-দাদির পৃথক বাসস্থানের নামও রাখা হয় তার নামে। জয়া ভিলা ও ললিতা ভিলা। ছোটবেলায় দুজনের কাছেই তিনি থেকেছেন।
১৯৫০ সাল
এই সালে জয়ললিতার বাবা জয়রাম মারা যান। মেয়ে জয়ললিতা ও ছেলে জয়কুমারকে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে বাপের বাড়ি চলে যান তার মা বেদাবাল্লি।
১৯৫২ সাল
জয়ললিতা ও তার ভাইকে বেঙ্গালুরুতে তাদের খালার কাছে রেখে মা বেদাবাল্লি কাজের খোঁজে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) চলে আসেন। সেখানে এলিট বিশপ কটন গার্লস স্কুলে ভর্তি হন জয়ললিতা। বেদাবাল্লি ‘সন্ধ্যা’ নামে নাটক ও সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। এ নামেই তিনি এখনো পরিচিত।
১৯৫৮ সাল
খালার বিয়ের পর মায়ের সঙ্গে থাকার জন্য মাদ্রাজ যান জয়ললিতা। সেখানে চার্চ পার্কে ভর্তি হন এবং মেধাবী হিসেবে প্রমাণ রাখতে শুরু করেন। এ সময় কারনেটিক সংগীত, ভরতনাট্যম ও কত্থক শেখেন তিনি।
১৯৬৪ সাল
‘চিন্নাদা গোম্বে’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। দেনায় জর্জরিত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে চলচ্চিত্রে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
১৯৬৫ সাল
এ বছর তার অভিনীত ‘বানিরাদাই’ সিনেমা সুপার হিট হয়। এরপর তার ভাগ্য আরো প্রসন্ন হয়। তৎকালীন তামিল সুপারস্টার এমজি রামচন্দ্রনের সঙ্গে জুটি বেঁধে ‘আয়রাথিল অরুবান’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এই সিনেমার মাধ্যমে ধরা দেয় অধরা সব স্বপ্ন। তবে এ সময়ই হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে জটিল সময়- তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৬৫-১৯৮০ সাল
এ সময় জয়ললিতার জীবনের স্বর্ণালি সময়। ১৪০টি সিনেমা করেছেন, যার মধ্যে ১২০টিই সুপার হিট। তার সময়ে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ সম্মানী নেওয়া অভিনেত্রী।
১৯৭০ সাল
অন্য অভিনেতার সঙ্গে অভিনয়ে রাজি হওয়ায় এমজিআরের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যায় জয়ললিতার।
১৯৭১ সাল
জয়ললিতার মা সন্ধ্যা মারা যান।
১৯৭৩ সাল
এ বছর এমজিআরের সঙ্গে শেষবার জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করেন। এর এক বছর আগে ডিএমকের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এআইএডিএমকে প্রতিষ্ঠা করেন এমজিআর।
১৯৮০ সাল
এ বছর একটি তামিল ও একটি তেলেগু সিনেমায় অভিনয় করে চলচ্চিত্রের জীবনের ইতি টানেন।
১৯৮১ সাল
এমজিআরের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগে।

১৯৮২ সাল
এমজিআরের রাজনৈতিক দল এআইএডিএমকে-তে যোগ দেন জয়ললিতা। অল্প সময়ের মধ্যে দলীয় সম্মেলনে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন তিনি।
১৯৮৩ সাল
এআইএডিএমকের প্রচার-প্রচারণা সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৮৪ সাল
রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। একাধিক ভাষায় পারদর্শী ও বহুমুখী জ্ঞানের অধিকারী জয়ললিতাকে এমজিআর রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত করাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন।
১৯৮৪ সালে বিধানসভা নির্বাচনে এআইএডিএমকে বিজয় পায়। তখন নির্বাচনী প্রচারের সময় এমজিআর হাসপাতালে ছিলেন। তারপরও জয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হওয়ায় জয়ললিতার ওপর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আস্থা বেড়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে এ নিয়ে এমজিআরের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়।
১৯৮৬ সাল
জয়ললিতাকে এআইএডিএমকের দলীয় সব পদ থেকে বহিষ্কার করেন এমজিআর। তবে তিনি রাজ্যসভার সদস্য থেকে যান।
১৯৮৭ সাল
এমজিআরের মৃত্যু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সেই অর্থে কেউ ছিলেন না। দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এমজিআরের স্ত্রী জানকির সঙ্গে জয়ললিতার দ্বন্দ্ব হয়। তখন দুই নারীকে কেন্দ্র করে এআইএডিএমকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
১৯৮৯ সাল
বিধানসভা নির্বাচনে ২৭টি আসন নিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী হন জয়ললিতা। এমজিআরের স্ত্রীর অনুসারীরা মাত্র দুটি আসন পায়। পরে তিনি এআইএডিএমকের নেতৃত্ব জয়ললিতার হাতে ছেড়ে দেন। তবে এ বছর তাকে রাজনৈতিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। তখন তিনি শপথ করেন, মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বিধানসভায় ফিরবেন।
১৯৯১ সাল
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা।
১৯৯১-১৯৯৬ সাল
দলীয় দুর্নীতির অভিযোগে জয়ললিতার জনপ্রিয়তায় ধস নামে। ঘনিষ্ঠ মানুষদের বিয়েতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করায় তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আসতে থাকে। দুর্নীতির অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন।
১৯৯৮-২০০৪ সাল
রাজনৈতিক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকে থাকেন জয়ললিতা। এরপর ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন। এ বছরেই সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় তাকে। ২০০২ সালে আবার মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন তিনি। অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হন। এদিকে ২০০৩ সালে তার অর্থ আত্মসাতের মামলা কর্ণাটক হাইকোর্টে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি হয়।
২০০৬-২০১৪ সাল
এ বছর বিধানসভা নির্বাচনে তার দলের চরম পরাজয় হয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যে আবার ঘুরে দাঁড়ান। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হন। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুতে ৩৯টির মধ্যে ৩৭টি আসন পেয়ে লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দলে পরিণত হয়।
সেপ্টেম্বর ২০১৪
অর্থ আত্মসাতের মামলায় আদালত তাকে চার বছরের জেল ও ১০০ কোটি রুপি জরিমানা করেন। মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারান তিনি এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতা পানেরসেলবাম। এক মাস কারাভোগের পর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি জামিন পান। ২০১৫ সালে কর্ণাটক হাইকোর্ট তাকে সব দায় থেকে মুক্তি দেন। ২৩ মে, ২০১৫ সালে তিনি আবার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন।
২০১৬ সাল
৩২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে জয়ললিতা ভারতে এক বিস্ময় মানবী। সোমবার মধ্যরাতে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান। তবে এর আগে কয়েকটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে। ৩ নভেম্বর হাসপাতাল জানায়, তিনি পুরোপুরি সুস্থ। ১৯ নভেম্বর তাকে আইসিইউ থেকে বের করা হয়।
৪ ডিসেম্বর চিকিৎসকরা জানান, জয়ললিতা শিগগিরই সুস্থসবল হয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু এদিন রাতেই তিনি হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। ক্রমেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জয়ললিতা বাড়ি ফিরেছেন, তবে জীবিত নন। তার মৃত্যুতে ভারতজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৬/রাসেল পারভেজ/ এএন
No comments:
Post a Comment