ছেঁড়াদ্বীপে ২০ বছর
জুয়েল রানা : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:04 May 2016 06:18:33 PM Wednesday || Updated:05 May 2016 01:10:31 PM Thursday

‘এখানে দুজনে নিরজনে
সাজাবো প্রেমেরও পৃথিবী
পাখি শোনাবে যে গান,
সুরে ভরিয়ে দেবে প্রাণ
ফুল দেবে ছড়িয়ে সুরভী’
দেশের সর্বদক্ষিণের স্থান ছেঁড়াদ্বীপ। এক খণ্ড স্বর্গের মতো এই দ্বীপে দাঁড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে এমনি ঘর বাঁধতে চেয়েছিলেন সালমান শাহ ও মৌসুমী! ১৯৯৩-৯৪ সালে ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল ছেঁড়াদ্বীপে। আর সেই ছবিতে গানে গানে সালমান-মৌসুমী একে অপরকে কথা দিয়েছিলেন সেখানে ঘর বাঁধার। তারা কথা রাখেননি! শালমান শাহ সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ১৯৯৬ সালে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আর মৌসুমীরও সময় হলো না।
কিন্ত সেই ঘর বাঁধার কথা হৃদয়ে গেঁথে নিয়েছিলেন আরেকজন। সালমান শাহ যখন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন, তখন নিজের পরিবারকে নিয়ে ছেঁড়াদ্বীপে স্বপ্নের পৃথিবী গড়লেন তাদের একজন ভক্ত হোসেন আলী! শুধু ভালোবেসে পরিবার নিয়ে নির্জন দ্বীপে বসতিই গড়লেন না, চালু করলেন নিজের প্রিয় নায়িকার নামে রেস্টুরেন্ট ‘হোটেল মৌসুমী’! ২০ বছর ধরে ছেঁড়াদ্বীপে এক এবং একমাত্র রেস্টুরেন্ট!
হোসেন আলীর আদি নিবাস সেন্টমার্টিনের দক্ষিণপাড়াতে। সেখান থেকে সে তার স্ত্রী ও পুত্র সাদ্দামকে নিয়ে চলে আসেন ছেঁড়াদ্বীপে। দিনের অর্ধেক সময় ছেঁড়াদ্বীপ থাকে বিচ্ছিন্ন। আর বছরে ৭ মাস থাকে সভ্য দুনিয়া থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন! এমন এক শৈলপ্রান্তরে সে বছরের পর বছর ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, এ যেন আরেক রবিনসন ক্রুসো!
কেয়া গাছের খুঁটি আর কেয়া পাতার ছাওনি মোড়া ঘর হোসেন আলীর। পর্যটকদের জন্য চিপস, বিস্কিট আর বহুদূর থেকে আনা মিষ্টি পানি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসতো সে প্রথম দিকটায়, এরপর বিভিন্ন প্রকার মাছ আর শুঁটকি ভর্তা দিয়ে লাঞ্চ! অমন খোলামেলা আর নির্মল পরিবেশে মৌসুমী হোটেলের যেন কোনো খাবার যেন অমৃত! সদা হাস্যজ্জ্বল মানুষটি ৪ ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে ২০১৩ সালে মারা যান। তাঁর সাথে আসা ৮ বছর বয়সী বড় ছেলে সাদ্দাম এখন ২৭ বছরের যুবক। তার হাতেই এখন সংসার আর বাবার রেখে যাওয়া মৌসুমী হোটেলের দায়িত্ব।
হোটেল মৌসুমীতে লেখক ও তার বন্ধুরা
বর্তমানে মাছের সাথে যুক্ত হয়েছে বাড়িতে পালা মুরগি আর ছাগল! ঘণ্টা দুয়েক সময় দিলেই হোসেন আলীর স্ত্রী আপনাদের রেঁধে খাওয়াবে ভাত, মাছ, মুরগি, শুঁটকি ভর্তা, ডাল জনপ্রতি ২০০ টাকার মধ্যে! আরো আগে খেতে চাইলে ফোন করে আগেই অর্ডার দিয়ে যেতে পারেন তবে ঝালের ব্যাপারটি একটু বলে নেবেন! আমরা তিনবার বলেছিলাম ঝাল কম দিতে, ওরাও বলেছিল ব্যাপারটা ওদের মাথায় আছে, তারপরও খাওয়ার সময় আমাদের ত্রাহি অবস্থা!
হোসেন আলীর স্ত্রী রাঁধেন ভালো, তবে তার চেয়ে বড় কথা অমন ঝলমলে প্রাকৃতিক পরিবেশে খাওয়ার সুযোগ আপনি হয়তো জীবনে খুব বেশি পাবেন না! চেয়ার-টেবিলে বসে খেলেও আমাদের বনভোজনই মনে হয়েছে বেশি।
সাদ্দাম জানালো, ৫ মাস তাদের ব্যস্ততা থাকে আর বাকি ৭ মাস প্রায় অবসর। এই সময় সে ঢাকা যায়, কিছু টুকটাক কাজ করে। তবে এবার সে পর্যটন মৌসুম শেষ হলে তাবলিগের চিল্লায় যাবে। তার স্বপ্ন ছেঁড়াদ্বীপে একটা রিসোর্ট তৈরি করা! যাতে পর্যটকরা এখানে রাতে থেকে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে আর তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়!
আপনারা যারা সেন্টমার্টিন হয়ে ছেঁড়াদ্বীপ যেতে চান, তাদের জন্য যাওয়ার রুটটি সংক্ষেপে বলে দিচ্ছি! ফকিরাপুল বাস স্ট্যান্ড থেকে সেন্টমার্টিন পরিবহণ, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, গ্রীনলাইন পরিবহণে সরাসরি টেকনাফ যেতে পারবেন। ভাড়া পড়বে নন এসি-৯০০ টাকা, এসি-১৬০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকা পর্যন্ত।
কেয়ারী সিনবাদ বা অন্যান্য নৌযানের টিকিটও ঢাকা থেকেই কিনতে পারবেন রিটার্ন টিকিটসহ ৫৫০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। অনেকে আগে থেকে সেন্টমার্টিনে হোটেল, লজ রিজার্ভ করে যায় কিন্ত আমার পরামর্শ হলো খুব রাশ আওয়ার না হলে ওখানে গিয়ে হোটেল বুক করুন। ওখানে কয়েকশ হোটেল-রিসোর্ট আছে, দেখে শুনে থাকতে পারবেন আর সেটা সাশ্রয়ীও হবে। যারা ছেঁড়াদ্বীপে গিয়ে দুপুরে খেতে চান, তারা সাদ্দামের সঙ্গে যোগাযোগ করে যেতে পারেন। সাদ্দামের ফোন নম্বর ০১৮১৫০৬৭৬৪০।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ মে ২০১৬/রাসেল পারভেজ/তারা
No comments:
Post a Comment