Sunday, 20 March 2016

Tortoises egg

Tortoises egg কচ্ছপের ডিম ও সোনাদিয়ায় বিপদ

ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:19 Mar 2016   02:09:49 PM   Saturday   
কচ্ছপের ডিম ও সোনাদিয়ায় বিপদ
ফেরদৌস জামান : এ বছর পহেলা জানুয়ারি বের হওয়ার কথা ছিল; দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল থেকে আরও দক্ষিণে সমুদ্রের বুকে দুবলার চরের উদ্দেশে। সঙ্গী-সাথী না থাকায় একা বের হব বলে ঠিক করি। প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি সেখানকার অস্থায়ী বাসিন্দাদের জীবন সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করাই ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুটকি প্রক্রিয়াকরণের উপযুক্ত সময়। এই সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতিক্রমে নির্দিষ্ট সংখ্যক জেলেকে দুবলার চরে অস্থায়ী নিবাস গড়ার সুযোগ দেয়া হয়। নির্ধারিত সময় শেষে জেলেরা পুনরায় চর ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য থাকে। সুতরাং, দুবলার চরে যেতে চাইলে নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি  উপযুক্ত ও একমাত্র মৌসুম।



যাত্রার আগের রাতে কথা হয় বাগেরহাটের এক পরিচিত জনের সাথে, থাকেন ঢাকায়। বিস্তারিত শুনে তিনি বললেন, উক্ত এলাকায় যাওয়া মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়ার শমিল। তাছাড়া একলা যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তার অন্যতম প্রধান কারণ জলদস্যু। কিডন্যাপ, মুক্তিপণ আদায় এমনকি মেরেও ফেলতে পারে। সুতরাং, আপাতত সিদ্ধান্ত বাতিল করে ৭ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হল। দুবলার চরে নাকি তার তিন বার যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। আবারও যাওয়ার ইচ্ছা রাখে। সে লক্ষে বলা হল, আমি যেন আরও দু-একজন জোগাড় করি। ওদিকে তারা তিনজন প্রস্তুত রয়েছেন। ৫-৭ জন হলে যাত্রাটা একই সাথে নিরাপদ ও আনন্দময় হয়ে উঠবে বলেও জানানো হল। ঠিক আছে, যাত্রা বাতিল করে অপেক্ষায় থাকলাম। অনেক চেষ্টার পর সর্বসাকুল্যে তিনজনকে সংগ্রহ করে প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। ওদিকে প্রস্তাবক মহোদয় লাপাত্তা। এক দিন, দুই দিন করে  এক সপ্তাহের জায়গা পেরিয়ে যায় দশ দিন। শেষ পর্যন্ত তাকে আর ধরতেই পারলাম না। সকলের আবেগের কথা চিন্তা করে বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধান করতে গিয়ে সামনে চলে আসে সোনাদিয়া দ্বীপের নাম।

 

ঢাকা থেকে কক্সবাজার হয়ে প্রথমে স্পিডবোটে যেতে হল মহেশখালী দ্বীপে। সময় বাঁচানোর খাতিরে ট্রলারের পরিবর্তে স্পিডবোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ঘাটে অপেক্ষায় রয়েছে বেশ কয়েকটি স্পিডবোট ও ট্রলার। ভাটার টানে পানি নেমে গেছে বেশ দূরে। দু-একটি বাঁশ অথবা কাঠের দীর্ঘ সাঁকো পাড়ি দিয়ে আরোহণ করি বোটে। জনপ্রতি ৭০ টাকা ভাড়া। কাঁধে বড় বড় ব্যাগ দেখে বোট চালক দাবি করে বসলেন, অতিরিক্ত একজনের ভাড়া না দিলে যাবে না। রাজী হওয়ার পর তবে ছেড়ে দিল। প্রায় ৪৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। কেওড়া বনের মাঝ দিয়ে এগিয়েছে জেটির সেতু। প্রায় দুইশ মিটার দীর্ঘ সরু সেতুর উভয় পাশ জুড়ে কেওড়া বন। গাছের ডালপালা চলে এসেছে সেতুর উপর। ইজিবাইক ও রিকশাগুলো যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটুখানি নরম কাটলেই দুই থেকে তিন গুণ বাড়িয়ে ভাড়া দাবি করে বসে। বিষয়টি আঁচ করতে  পেরে বুঝেশুনেই দরদাম করতে হল।



মহেশখালী একটি দ্বীপ যা কক্সবাজার জেলার একটি উপজেলা। আর এই দ্বীপ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ সোনাদিয়া। এ পর্যায়ে মহেশখালীর ঠিক দক্ষিণ ঘাটে গিয়ে ট্রলারের প্রতীক্ষায় থাকলাম। জোয়ারের পানি কখন আসবে তারপর ট্রলার ভাসবে। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে বেজে গেল বিকেল তিনটা। খবর এলো ওপাড় থেকে ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে, চলে আসবে ঘণ্টা খানেকের  মধ্যেই। মাঝের সময়টি কেটে গেল স্থানীয়দের সাথে কথা বলে। ৪র্থ শ্রেণীতে পড়া জাবের সোনাদীয়া থেকে মহেশখালী এসেছে দোকানের সদাইপাতি করতে। মহেশখালী বিখ্যাত লবণ, শুটকি আর মিষ্টি পানের জন্য। জাবেরের সাথে দূরে হেঁটে গিয়ে ছনে ছাওয়া এক দোকনে মিষ্টি পানের অর্ডার করলে চুন-সুপারী  আর মসলা সহযোগে বানিয়ে দেয়া হল এক খিলি। কিছুক্ষণ চাবানী দেয়ার পর মুখের মধ্যে মিষ্টি স্বাদের অনুভব খুঁজতে থাকি। কই, মিষ্টি কোথায়? স্থানীয় দূর্বোধ্য ভাষায় দোকানী বুঝিয়ে দিলেন মিষ্টি মানে গুড় বা চিনির মিষ্টি নয়, এই পানে ঝাল বা ঝাঁজ নেই। এবার বুঝলাম কোন অর্থে মহেশখালীর পানকে মিষ্টি বলা হয়ে থাকে।



আমাকে পান খাওয়াতে পেরে জাবেরের চোখে-মুখে যেন স্বার্থকতার হাসি ফুটে উঠল। তারপর কথা হয় শুটকি এবং লবণ খামারী ও সাগর থেকে চিংড়ি পোনা আহোরণকারীদের সাথে। ট্রলার আসতে দেরি হয়ে বরং ভালো হল, জানা গেল প্রান্তিক পর্যায়ের এই সমস্ত শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন জীবিকার দু-চারটি কথা। ট্রলার এলে আমাদের চারজনকে স্বসম্মানে বসতে দেয়া হল সব থেকে ভালো জায়গায়। ভাঙ্গাচোরা আর তালি-পট্টি দেয়া ট্রলারটি ছেড়ে দিল সোনাদিয়ার উদ্দেশ্যে। সাঁতার না জানা সাফাত আতঙ্কে কাঁপছে। ওর পরিস্থিতি দেখে এবার তো ট্রলারের অন্যান্য যাত্রীরা তাকে বোঝাতে আরম্ভ করল, ভয়ের কারণ নেই, কিছুই হবে না ইত্যাদি। প্রবেশ করলাম কেওড়া বনের মাঝে সবুজ ঘেরা খালে। মিষ্টি রোদে ঝকঝকে কেওড়া পাতাগুলি থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে অজস্র আলোর ঝিলিক। গাংচীলের ঝাক ট্রলারের পিছে পিছেই এগিয়ে চলছে। খালের পাড়ে সাদা বক অপলক দৃষ্টিতে প্রতীক্ষা করছে কখন একটি রূপালি মাছ ভেসে ওঠে।



ছোট্ট দ্বীপ সোনাদীয়া, বসতি হাতে গোনা। প্রায় প্রত্যেকেরই পেশা মৎস্য আহরণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে মসজিদভিত্তিক মক্তবই একমাত্র ভরসা। এ ছাড়াও বসতির উত্তর পাশে বিদ্যালয়ের জন্য এক নকশাদার ভিত্তি স্থাপন করে রাখা হয়েছে। মহৎ উদ্যোগ; তবে জানা গেল না প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা এর উদ্যোক্তা? দেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অথবা প্রান্তিক পর্যায়ের সুবিধা বঞ্চিত এই মানুষগুলির বঞ্চনা আর না পাওয়ার বিষয়টি এক সম্ভাবনাময়ী খাত বটে। এনজিওগুলির অন্যতম লক্ষ এই সমস্ত এলাকার নানামুখী উন্নয়নের ডালপালা ছড়ানো। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলি তো দানের ডালা বিছিয়ে বসে থাকে, কোথায় ঢালবে সে অর্থ, যার অন্তরালে লুকায়িত থাকে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যাহোক ‘ঘর পোরা গরু সিদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’ ধরনের চিন্তা ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আপাতত বরং উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানিয়ে এগিয়ে চললাম। বসতির পশ্চিমে প্রশস্ত বালিয়াড়ীর পর ঝাউবন, ঠিক তার পর থেকেই সৈকত। অনবরত অছড়ে পড়ছে একেকটি ঢেউ। সূর্য মামা পটে বসেছে, খানিক বাদেই ডুব দেবে দীগন্ত জোরা জলরাশির বুকে। উচ্ছ্বাস দেখার কেউ নেই, সমস্ত সৈকতজুড়ে মানুষ কেবল আমরাই চার জন।



ঝাউ বনের এক সুবিধাজনক জায়গায় তাবু খাটানোর ব্যবস্থা করা হল। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙে জেলেদের কোলাহলে। কোমরে দড়ি বেঁধে সমস্বরে-হেইও এবং অন্যান্য গান গেয়ে টেনে তুলছে জাল। নিকটেই দ্বীপের একমাত্র কাছিম প্রজনন কেন্দ্র। আট-দশ বছরের শিশুটি ব্যাগ ভর্তি কাছিম-ডিম নিয়ে হাজির, আমাদের দেখানোর জন্য। একটু আগেই সৈকতের এক গর্ত থেকে সংগ্রহ করেছে। নরম তুলতুলে প্রতিটি ডিম। হাস মুরগির ডিমের মত শক্ত খোলসওয়ালা নয় এবং আকারে গোল গোল। সে জানায় একটি কাছিম একবারে দেড়-দুইশ বা তারও অধিক ডিম দিয়ে থকে। নরম; তাই আলতো করে স্পর্শ করতে গেলে ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলেটি একটি ডিম আকাশে ছুঁড়ে মেরে বলল, এই দেখেন ভাঙবে না। হ্যাঁ, দেখি সত্যিই তাই। এই ডিম প্রজনন কেন্দ্রে কৃত্রিম পদ্ধতিতে  নির্দিষ্ট সময় তাপ দিয়ে বাচ্চা ফুটানো হয়। সেগুলো ছেড়ে দেয়া হয় সমুদ্রের বুকে।

সৈকত ধরে হাঁটতে চাইলে স্থানীয়রা জানায়, পশ্চিম পাড়া (পশ্চিম সোনাদিয়া) এর দিকে না যেতে। প্রকৃত কারণ জানতে চাইলে বলে, একটু ঝামেলা রয়েছে। পরে অবশ্য জানতে পারি, কিছু দিন আগে ওদিক থেকে তিনজন পর্যটক নিখোঁজ হয়েছিল। অনেক মারধর করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টায় তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ভেবে বড়ই দুঃখ হল, কি সমুদ্র, কি পাহাড় আর কি বন-জঙ্গল; কোথাও গিয়ে নির্বিঘ্নে, নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেই। আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের পেছনে এক ভীতি তাড়া করে বেড়ায় সর্বক্ষণ।

 http://www.risingbd.com/%E0%A6%B8%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A7%82%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%89-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE/152006

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৬/তারা

No comments:

Post a Comment