ইংল্যান্ডে মুসলিমদের আগমন যেভাবে
শাহিদুল ইসলাম : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:28 Mar 2016 10:54:22 PM Monday || Updated:29 Mar 2016 11:35:18 AM Tuesday

উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধিতে এ যুগে ইংল্যান্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, সাম্রাজ্য বিস্তার, জ্ঞান-বিজ্ঞান সবদিকেই তাদের উন্নতি হয়েছিল।
এলিজাবেথিয়ান যুগে যে সমস্ত বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল বহুজাতিভিত্তিক সংস্কৃতির অর্থাৎ ব্রিটিশদের সঙ্গে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সংমিশ্রণ।
ধারণা করা হয় এ যুগেই মুসলমানরা প্রথম স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে বসবাস শুরু করে। শুধু তাই নয় তারা প্রকাশ্যে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন শুরু করে। মূলত এই ষোড়শ শতাব্দীতেই উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়ার বাইরে ইংল্যান্ডে মুসলিম জনগোষ্ঠী কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, সংগীতশিল্পী, বাদক-অনুবাদ এমনকি পতিতা হিসেবেও কাজ শুরু করে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এই শতাব্দীতেই কেন ইংল্যান্ডে এত বেশি মুসলিমের আগমন ঘটল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে পিছনে ফিরে যেতে হবে।
রানি প্রথম এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন ১৫৫৮ সালে। এর এক যুগ পরের কথা। ১৫৭০ সাল। তার এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীকে পোপ পঞ্চম পিয়স (১৫০৪-১৫৭২) গির্জা থেকে বহিষ্কার করেন। এ ঘটনায় রানি এলিজাবেথ ক্ষুব্ধ হন।
রানি এলিজাবেথ ইউরোপ বিশেষত ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্য বিশেষত মরক্কোর সাদিয়ান, অটোমান ও পার্সিয়ান শিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক মৈত্রীজোট গঠন করেন।
তবে পোপ পিয়স ছিলেন রানির উল্টো পথে। ১৫৭০ সাল পর্যন্ত পোপের জারি করা ডিক্রি বা আদেশের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক গির্জাগুলোর জন্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সকল প্রকার ব্যবসা-বাণিজ্য বা মৈত্রীজোট গঠন নিষিদ্ধ করে রেখেছিলেন।
কিন্তু মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে জোট গঠন ছাড়াও রানি এলিজাবেথ মুর, ইন্ডিয়ান ও আফ্রিকান নিগ্রোদের কাছেও দূত প্রেরণ করেন। রানি প্রত্যেকর কাছে এই বার্তা পাঠান যে, তারা ধর্মীয় মতপার্থক্য ভুলে যেন ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করে এবং চাইলে তারা ইংল্যান্ডে এসে বসতি স্থাপন করতে পারে।
রানি এলিজাবেথের শাসনামলের আগে অন্যান্য খ্রিষ্টান দেশের মতোই ইংল্যান্ডের লোকেরা ইসলামকে একটি বিকৃত ধর্ম হিসেবে জানত। আশ্চর্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে, ইংরেজি ভাষাতে ইসলাম বা মুসলিম শব্দটি প্রবেশ করে সতের শতকে। এর আগে তারা মুসলমানদের বোঝাতে সারাসিন শব্দটি ব্যবহার করত, যার অর্থ হলো আরব বেদুইন।
বিপরীত ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে খ্রিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসীরা মুসলমানদের মনে করত তারা একটি অসঙ্গতিপূর্ণ ধর্মে বিশ্বাস করে যেটা প্রাচীন প্যাগন বা মূর্তিপূজারীদের ধর্ম থেকে উদ্ভূত। এর ফলে তারা মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ এড়িয়ে চলত। কিন্তু রানি এলিজাবেথের বিভিন্ন মুসলিম দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জোট গঠনের পর থেকে মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ শুরু করে ব্রিটিশরা।
সিংহাসনে বসার পরেই রানি পারস্যে(বর্তমান ইরান) প্রথম তার দূত প্রেরণ করেন। পারস্য থেকে ফেরার সময় তার বার্তাবাহকেরা অরা সুলতানা নামের এক সুন্দরী তাতার দাসীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অরা সুলতানা পরে রানির স্নেহের পাত্রী ও আস্থাভাজন হন। জেনে অবাক হবেন, এই দাসীই রানিকে ওই সময়ের রুচিশীল জুতা (স্প্যানিশ চামড়ার জুতা) পরিধান করতে শেখান।
১৫৮৬ সালে ফ্রান্সিস ড্রেক নামের অপর এক বাণিজ্যদূত কলম্বিয়া থেকে ফেরার সময় ১০০ তুর্কি জলদূস্য, যাদের ভূমধ্যসাগর থেকে ধরা হয়েছিল, তাদের দাস হিসেবে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। এই দাসদের মধ্যে সিনানো নামের এক দাস ছিলেন, যিনি ইংল্যান্ডের ইতিহাসে মুসলিম থেকে ধর্মান্তরিত প্রথম প্রোটেস্টান খ্রিষ্টান। টাওয়ার লন্ডনের কাছে সেন্ট ক্যাথরিন গির্জায় খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন সিনানো। খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সময় সিনানো মজার একটি উক্তি করেন। উক্তিটি ছিল এ রকম- ‘যদি ইংল্যান্ডে ঈশ্বর না থাকে তবে পৃথিবীর কোথাও নেই।’
সমালোচকরা বলেন, সিনানো মোটেও খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে এ কথা বলেননি। মূলত তিনি তার ইংরেজ প্রভূদের খুশি করার জন্য একথা বলেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে- কিছু দিনের মধ্যে এই সিনানো যখন পুরোদস্তর ব্রিটেনের নাগরিক হয়ে ওঠেন, তখনই তিনি পালিয়ে আবার তার আগের ধর্ম গ্রহণ করেন।
প্রকৃতপক্ষে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল- তুর্কিদের চেয়ে সহজে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ। কারণ খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তখন খুব দ্রুত নাগরিকত্ব পাওয়া যেত। এভাবেই বিভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্য থেকে আগত মুসলিমরা তৎকালীন ইংল্যান্ডে বসতি গড়তে শুরু করেন।
অন্যদিকে রানি এলিজাবেথ যে সমস্ত বার্তাবাহক মুসলিম বিশ্বে পাঠিয়েছিলেন তাদের সবাই কিন্তু ইংল্যান্ডে ফিরে আসেননি। অনেকে সেখানেই বসতি গড়েছিলেন এবং কেউ কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে স্যামসন রাউলি অন্যতম।
১৫৭৭ সালে স্যামসন রাউলিকে আলজেরিয়ার জলদুস্যরা বন্দি করে এবং তাকে খোজা করা হয়। তাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। তার নাম দেওয়া হয় হাসান আগা। এই হাসান আগা পরবর্তীতে আলজিয়ার্সের প্রধান কোষাধক্ষ্য ও অটোমান সাম্রাজ্যের বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হন।
বিভিন্ন রেকর্ডপত্র ঘেঁটে জানা যায়, রানি এলিজাবেথ অটোমান, মরক্কান এবং তুর্কি সাম্রাজ্যের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন যেনেআরো বেশি পরিমাণে সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের ইংল্যান্ডে এনে স্থায়ী নাগরিকত্ব প্রদান করা যায়।
রেকর্ডপত্র থেকে আরো জানা যায়, ১৫৮৯ সালে মরক্কান সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মচারী আহমেদ বিল কাসিম ইংল্যান্ডে আসেন এবং রানিকে মরক্কোর সঙ্গে যৌথভাবে স্পেন আক্রমণের প্রস্তাব দেন। যদিও এই প্রস্তাবে রানি সাড়া দেননি। এরপর তিনি মরক্কো ফিরে যান।
এই আগমন-প্রত্যাগমনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে বিভিন্ন মুসলিম রীতিনীতি মিশে যায়। ইংল্যান্ডের সংস্কৃতি হয়ে উঠে আরো সমৃদ্ধ। রানি এলিজাবেথের আকস্মিক মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির অবসান ঘটে। এ ছাড়া রানির উত্তরসূরীরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আর চুক্তি তো করেননি বরং তারা স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলে। এতে করে তারা মুসলিম বিশ্ব থেকে আরো দূরে সরে যায়।
অনেক ইতিহাসবিদ ইংল্যান্ডে মুসলমানদের এই উপস্থিতি মোটেও ইতিহাসের বড় কোনো ঘটনা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তবে কেউ স্বীকার করুন আর নাই করুন, নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায়, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে মুসলমানদের এই উপস্থিতি বেশ তাৎপর্য বহন করে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৬/রাসেল পারভেজ/নওশের
No comments:
Post a Comment