যে কারণে সবচেয়ে শ্রুতিমধুর বাংলা ভাষা
সাইফ : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:09 Apr 2016 08:05:44 AM Saturday || Updated:09 Apr 2016 12:42:00 PM Saturday
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধতম জন্মবার্ষিকীতে ভারতের বিশিষ্ট লেখক দিবেন্দু পালিতও ঠিক একই কথা বলেছিলেন, ‘বাংলা পৃথিবীর সবথেকে শ্রুতিমধুর ভাষা’। তবে শুধু দিবেন্দু পালিত-ই নন, বিশ্বের সব প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানীরাও সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রুতিমধুর ভাষা হিসেবে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলাকে।
ব্যবহারের দিক থেকে তালিকার অষ্টম স্থানে থাকা এই বাংলা ভাষা শ্রুতিমধুর হওয়ার নেপথ্যে বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেসব বিষয়ের ওপর মতামত দিয়ে ভাষা বিজ্ঞানীরা বাংলাকে সবথেকে মধুর ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। চলুন জেনে নিই সেই কারণগুলি :
• সরল স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জণবর্ণে নির্মিত শব্দসমূহ : বাংলা ভাষার শব্দের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে বাংলা খুব শক্ত এবং টেনে টেনে উচ্চারণ করা শব্দের পরিমান নেই বললেই চলে। এই ভাষায় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জণবর্ণে সার্থক মিলনে শব্দের উচ্চারণ আরও মধুর হয়ে ওঠে। কাছাকাছি উচ্চারণের পার্থক্যের জন্যও বাংলা শব্দে রয়েছে আলাদা আলাদা বর্ণমালা।
• একই উচ্চারণের জন্য ভিন্নধর্মী বর্ণ : শব্দের উচ্চারণ আরও সহজ করে তোলার জন্য একই ধরনের উচ্চারণে ভিন্ন ধরনের বর্ণ আছে বাংলায়। এবং সেগুলো নিয়মিত প্রয়োগ হয় এই ভাষায়। এর মধ্যে ‘শ,স,ষ’ ছাড়াও ‘ন,ণ’ ‘র,ড়,ঢ়’ ইত্যাদি বর্ণগুলো এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
• শব্দের শেষে স্বরবর্ণের উপস্থিতি : বাংলা শব্দের শেষে স্বরবর্ণের দৃশ্যমান উপস্থিতি না থাকলেও এর একটি অদৃশ্য প্রভাব সবসময়ই আছে। যার কারণে প্রতিটি শব্দের মধ্যেই একরকমের অনুরণন তৈরি হয়, এর ফলে বাংলা ভাষায় মধুরতা তৈরি হওয়া অতিপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়। ইতালিয়ান, তেলেগু কিংবা স্প্যানিশ ভাষায় এই ধ্বনির প্রভাব থাকলেও বাংলা স্বরবর্ণের ধ্বনিগুলো বাংলা শব্দের শেষে সবথেকে বেশি শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। এবং ভাষা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলো ভিন্ন ধ্বনির হয়ে যায়। যেমন সূর্য, বসন্ত, কর্ম- শব্দ তিনটি হিন্দি ভাষায় পরিবর্তিত হয়ে সওয়ারগ, বাসান্ত, কারম- হিসেবে তিনটি আলাদা ধ্বনির শব্দ হয়ে ওঠেছে।
আবেগময় অভিব্যক্তির ঐশ্বর্য : মানুষের প্রত্যেক অনুভূতি সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মভাবে প্রকাশ করার জন্য বাংলা ভাষায় রয়েছে একাধিক শব্দ। অন্য কোনো ভাষার শব্দভাণ্ডারে আবেগের এত সূক্ষ্ম প্রকাশ ঘটানোর এত বহুল উপাদান নেই। এই অনুভূতি প্রকাশ করার স্বাধীনতার কারণে ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলা ভাষাকে সবসময়ই উপরে তুলে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষায় ‘ইস’ কিংবা ‘ধুত্তরি’ ধরনের শব্দের প্রয়োগ অন্যভাষায় তুলনামূলক অনেক কম দেখা যায়।
সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার : সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলি, ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দ বাঙালি আদলে বাংলা ভাষায় ঢুকে পড়ায় এই ভাষার শব্দভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ। বক্তা যাই বলতে চান ঠিক তা-ই যেন প্রকাশ করা সম্ভব হয় এই ভাষায়। তাই শব্দের প্রাচুর্যতা থাকায় ভিন্ন ভিন্ন ভাব প্রকাশের অবলীলায় বক্তা তার সূক্ষ্ম অনুভূটিও প্রকাশ করতে পারেন। যার জন্য পৃথক শব্দের একাধিক প্রয়োগ দেখা যায়। এইসব একাধিক শব্দের বহুল ধ্বনির কারণে বাংলা হয়ে ওঠে আরও শ্রুতিমধুর। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট এবং বোধগম্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এ ছাড়া বাংলা শ্রুতিমধুর কিংবা শক্তিশালী হওয়ার পেছনে অনেক কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ভাষা বিজ্ঞানীরা। যেমন বাংলা ভাষায় শুধু ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি বাঙ্গালিদেরকে যতটুকু শক্তি দেয় অন্য কোনো ভাষার জনগোষ্ঠীদের কাছে এমন শব্দমালা খুব কমই আছে। ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, শব্দে স্বল্প এবং দীর্ঘ উচ্চারণের জন্য পৃথক স্বরবর্ণ থাকায় বাংলাশব্দ একটি অত্যাধুনিক স্বরভঙ্গি দেয়। যে কারণে ভাষাটি শ্রোতার কাছে মধুর হয়ে ওঠে সহজেই।
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ কথা বলে এই ভাষায়। সবথেকে শ্রুতিমধুর ভাষার স্বীকৃতি ছাড়াও বিশ্ববাসীর ভেতরে মাতৃভাষাকে তীব্রভাবে ভালোবাসার বাসনা তৈরি করার এক দূর্লভ অভিজ্ঞতা রয়েছে এই ভাষার মূল জনগোষ্ঠীর।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ এপ্রিল ২০১৬/সাইফ
No comments:
Post a Comment