ভিন্ন রীতির এক বৈশাখী মেলা
ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:14 Apr 2016 04:01:45 PM Thursday
অতীতে সমগ্র বাংলায় মহাস্থানের বৈশাখী মেলার স্থান ছিল অনেক উঁচুতে, চলত মাসব্যাপী। মেলায় সাধারণত পণ্য সামগ্রীর পাশাপাশি গরু-ছাগল থেকে শুরু করে হাতি-ঘোড়া পর্যন্ত বিকিকিনি হতো। উল্লেখ্য, এই মেলার মৃত্যু ঘটেছে দুই দশকের কিছু সময় আগে। বগুড়ার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে আমাদের প্রজন্মই বোধ হয় মহাস্থান মেলার ধুকে ধুকে মৃত্যু দেখার সর্বশেষ সাক্ষী। এই মেলার মৃত্যু হলেও এর বদলে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বৈশাখ পালনের ভিন্ন এক রীতি; সম্পূর্ণ আলাদা এক উদ্দীপনা থেকে এটি উদযাপিত হলেও এটিই এখন মহাস্থান মেলার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে উঠেছে।
প্রতি বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার পালিত হয় সাম্প্রতিক কালের আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মহা মিলনমেলা। ছোট বেলায় মেলায় যাওয়ার সুযোগ থাকলেও পরবর্তীতে নতুন সংস্করণের মহাস্থান মেলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে থাকত কঠোর নিষেধাজ্ঞা। তার প্রধান কারণ মেলার উদযাপন পন্থা। এ দিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত জটাধারী তথাকথিত সাধু সন্যাসীরা গঞ্জিকা সেবনের অবাধ মচ্ছবে মেতে ওঠে এই মেলাকে কেন্দ্র করে। মেলার আবহের প্রভাবে কখনও কখনও উৎসাহী সাধারণ জনতাও তা থেকে বাদ যায় না।
পুন্ড্রনগরের সুদীর্ঘ প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী আজকের মহাস্থান গড়। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল শাসকবর্গের প্রাদেশীক রাজধানী ছিল। পরবর্তীতে সনাতন (হিন্দু) সামন্ত রাজাগণের রাজধানী ছিল। বগুড়া শহর থেকে ১৩ কি.মি. উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে এর অবস্থান। সমগ্র বাংলার সর্বপ্রাচীন এ দূর্গনগরী চারদিকে উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত, যার বেশির ভাগ অংশ ভূমিকম্প ও নানা কারণে মাটির পড়তে ঢেকে গিয়ে এক গড়ের আকার ধারণ করেছে। গড়ের সর্বাপেক্ষা উঁচু জায়গায় কথিত সুফি শাহ্ সুলতান মাহী সওয়ার-এর কবর। কবর প্রাঙ্গণ ঘিরেই বসে লক্ষ মানুষের মিলন মেলা।
পরিবারের বাঁধা সত্ত্বেও বেশ কয়েক বছর পূর্বে মহাস্থান মেলায় যাওয়ার সুযোগ মেলে। সাথে ছিলেন দৌলত জামান চাচা। মানুষের প্রবল ভিড়ে বাসস্ট্যান্ডের আধা কি.মি. আগেই বাস থেকে নেমে পড়তে হল। তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। মানুষের ভিড় ঠেলে অগ্রসর হতে থাকলাম। গাঁজার ধোঁয়ার উৎকট গন্ধ অনেক দূর থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। পথের দুপাশে বসেছে মহাস্থানের বিখ্যাত কটকটির (তেলে ভাজা চালের আটার টুকরো গুড়ের মসলাদার সিরায় ভিজিয়ে তোলা) দোকান। হেন লোক নেই যার হাতে দু’এক কেজি কটকটির ব্যাগ ঝুলছে না। শাহ্ সুলতানের মাজারের অবস্থান প্রায় দশ মিটার উঁচুতে। সেখানে ওঠার জন্য তিন দিক দিয়ে স্থায়ী সিঁড়ির ব্যবস্থা করা রয়েছে। মানুষের ভিড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়ে ধরতে হল বিকল্প পথ। গড়ের উপর মাজারের পাশে খোলা মাঠ পর্যন্ত বাস, ট্রাক উঠে যাওয়ার চমৎকার পথ রয়েছে। সেই পথে উঠতে গিয়েও বিফল। অবশেষে লক্ষ করি জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কিছু লোক লাইন ধরে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠছে। তাদের অনুসরণ করে আমরাও উঠতে থাকলাম। কয়েক গজ ওঠার পর দেখি মাটি খানিক রসাল ও নরম। সুতরাং, পিছলে পড়ার ঘটনাও ঘটল দু’একটা। অতি সাবধানে উপরে উঠে বুঝতে পারি, যে পানির কারণে এতক্ষণ আরোহণের পথ ভেজা ও পিচ্ছিল ছিল তা সাধারণ পানি নয়, সেপটিক ট্যাংক উপচে গড়িয়ে পরা পানি। বোকা বনে যাওয়া কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করলাম যাতে চেনাজানা কেউ দেখে না ফেলে! অত মানুষের ভিড়ে পয়পরিস্কারের ব্যর্থ চেষ্টা না করে উৎসব দেখায় মনোযোগী হলাম।
স্থানীয় দু’চার জনের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করলাম মেলার পেছনের কথা, অর্থাৎ ইতিহাস। মহাস্থান নিয়ে রয়েছে এক কিংবদন্তি, যার উপস্থাপন বা পরিবেশন একেকজনের মুখে একেকরকম। এক সময় মহাস্থান ও তার আশপাশের এলাকা শাসন করত পরশুরাম নামের এক রাজা। সে ছিল ভয়ানক অত্যাচারী। দিনের পর দিন তার অত্যাচারে প্রজা সাধারণ অতিষ্ট। পরশুরামের রাজ্যে একমাত্র মুসলমান নাগরিক ছিল নিঃসন্তান বোরহান উদ্দীন। বোরহান উদ্দীন সৃষ্টিকর্তার নিকট একটি সন্তান প্রার্থনা করেন এবং মানত করেন সন্তান জন্মালে গরু কোরবানী দেবেন। সৃষ্টিকর্তা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। অতঃপর মানত পূরণের লক্ষে বোরহান উদ্দীন একটি গরু কোরবানী দেন। কোরবানী করা গরুর এক টুকরো মাংস চিল নিয়ে ফেলে রাজ দরবারে। প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে ক্ষিপ্ত রাজা বোরহান উদ্দীন ও তার পরিবারকে দরবারে ডেকে পাঠায় এবং তার দুই হাত কর্তনের আদেশ দেয়। শুধু তাই নয়, চোখের সামনে তার নবজাতক সন্তানকে হত্যা করে। সেই পরিস্থিতিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোরহান উদ্দীন সৃষ্টিকর্তার নিকট এই নিষ্ঠুরতার বিচার চেয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে মাটিতে লুটে পড়েন।
ওদিকে আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে সমস্ত ঘটনা জানতে পারলেন সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের সুফি সাধক শাহ্ সুলতান বলখী। তিনি বৃহৎ এক মাছের পিঠে আরোহণ করে দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মহাস্থানে এলেন। সৃষ্টিকর্তার রহমতের আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা অত্যাচারী রাজা পরশুরামের বাহিনীকে খতম করে রাজাকেও বধ করলেন। উক্ত পরিস্থিতিতে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে শাহ্ সুলতানের নিকট নতি স্বীকার না করে, রাজার একমাত্র বোন শীলাদেবী করতোয়া নদীতে প্রাণ বিসর্জন দেন। দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। সেই থেকে বৈশাখের শেষ বৃহস্পতিবার এলাকার সনাতন ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের নিকট তাৎপর্যপুর্ণ। তারা মেলায় সমবেত হয় পুণ্য লাভের আশায়। যদিও বঙ্গের ইতিহাস গবেষণায় আজও পর্যন্ত উল্লেখিত ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
দিনটিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শীলাদেবীর ঘাটে পুণ্যস্নান করেন। কেননা রাজা পরশুরাম পরাজয়ের পর শীলাদেবী মুসলমানের নিকট আত্মসমর্পণ না করে নদীতে প্রাণ বিসর্জন দেন। অন্যদিকে বিজয়ের দিন হিসেবে মুসলমানরা শাহ্ সুলতানের মাজারে সিন্নি পায়েস দিয়ে মিলাদ মাহফিল করেন। কেউ কেউ আবার সারা রাত ধরে জিকির করেন। এ ছাড়াও দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত সুফি সাধকগণ সারা রাত ধরে মারফতি গনে মগ্ন থাকেন। এভাবেই একমাসব্যাপী বৈশাখী মেলার সাথে এই অনুষ্ঠান যুক্ত হয়ে ধারণ করে এক ভিন্ন মাত্রা। বর্তমানে গানবাজনার সাথে চলে প্রকাশ্যে গাঁজা সেবনের ধুম। যদিও গত কয়েক বছর হল মেলায় প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন প্রতিরোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জারি রয়েছে বিশেষ কঠোরতা।
যাই হোক, খানিক এগিয়ে গিয়ে দেখি পাথরের (অতীতের দুইটি বৃহদাকার প্রস্তর খণ্ড) উপর উভয় ধর্মের অনুসারীরা মনের আশা পূরণে মানতস্বরূপ দুধ ঢেলে দিচ্ছে। কাচা দুধ আর গাঁজার গন্ধে অত্র এলাকায় এক ভিন্ন রকম আবহ। মাজারের সামনের বড় চত্বরে ওয়াজ মাহফিলের সামিয়ানা, মাইকে উচ্চ শব্দে চলছে বয়ান। পাশেই আবার বিক্রি হচ্ছে চুড়ি- ফিতা, দুল-ক্লিপ এবং নানান প্রসাধনী ও খেলনা। অদূরে গড়ের আরেক সমতল মাঠে স্থানীয় যুবকদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হচ্ছে নাটক। মাজারের উত্তর পাশে অতি পুরনো বট বৃক্ষগুলোর নিচে নানা দলে বিভক্ত হয়ে বসেছে গানের আসর। একতারা, দোতারা, মন্দিরা ও খঞ্জনী সহযোগে পরিবেশিত হচ্ছে মারফতি গানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধারার লোকগীতি। ঠিক তার পাশেই ডেকচি পাতিলে রান্না হচ্ছে খিচুরি, পায়েস ইত্যাদি। মাজারের আরেক পাশে এগিয়ে দেখি সেখানেও বসেছে একাধিক আসর তবে তা গানবাজনার নয়। কৌতূহল বোধ করায় একজন জানাল, মেলা উপলক্ষে কিশোর যুবকদের উদ্যোগে পাড়ার সকলের নিকট থেকে দু’চার টাকা চাঁদা তোলা হয়। সেই টাকায় দুধ, চিনি ও চাল কিনে পায়েস রান্না করা হয়। তারপর মাজারে খানিকটা দিয়ে বাকি পাড়ায় নিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়ে থাকে।
এই কাজটি প্রতি বছরই করা হয়। মেলার রূপ পরিবর্তিত হলেও মহাস্থানের নিকটবর্তী এলাকার মানুষের নিকট তা আজও সমান গুরুত্ববহ। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে মেয়ে জামাইকে দাওয়াত করে এনে আদর আপ্যায়নের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিশেষ সতর্কতা। পার্শ্ববর্তী ‘গড় মহাস্থান’ নামক গ্রামে গিয়ে দেখি কিশোর কিশোরীরা নতুন পোশাক পরে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি। পরিবেশিত হচ্ছে নানা পদের মিষ্টান্ন। সব শেষে উপলব্ধি করি, সামাজিক বন্ধন মজবুত বা অটুট রাখতে ধর্মীয় ও সামাজিক অন্যান্য অনুষ্ঠানের ন্যায় মহাস্থান বৈশাখী মেলারও রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৬/তারা
No comments:
Post a Comment