গয়ানাথের বালিশ
ইকবাল হাসান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:13 Apr 2016 08:02:29 AM Wednesday || Updated:13 Apr 2016 02:52:50 PM Wednesday
ঐতিহ্যবাহী গয়ানাথের ‘বালিশ মিষ্টি’
নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি যুগ যুগ ধরে ধরে রেখেছে তার ঐতিহ্য। গয়ানাথের বালিশ বললে এক নামে সবাই চেনে এটি।
বালিশ মিষ্টি দেখতে অনেকটা কোল বালিশের মতো। জেলার গণ্ডি পেরিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা এমনকি দেশের বাইরেও এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। সুদূর আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা ও সৌদি আরবেও এ মিষ্টির নাম ছড়িয়ে আছে।
নেত্রকোনায় বেড়াতে এসে রসনাতৃপ্তির জন্য সবাই খোঁজ করেন বালিশ মিষ্টির। তৃপ্তি নিয়ে খাওয়ার পর আবার যাওয়ার সময় প্যাকেটে করে নিয়েও যান প্রিয়জনদের জন্য। আশপাশের জেলা এমনকি প্রবাসীরা প্রবাসে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সময় নিয়ে যান নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী গয়ানাথের বালিশ।
জানা গেছে, প্রায় ১১২ বছর আগে জেলা শহরের বারহাট্টা রোডে গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী গয়ানাথ ঘোষ এ মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন। বারহাট্টা রোডে তার ছিল ছোট্ট মিষ্টির দোকান।
গয়ানাথ ঘোষ দুধ দিয়ে অনেক ধরনের মিষ্টি বানাতেন। এসব মিষ্টি কমবেশি সব দোকানিই বানাতে পারত। গয়ানাথ ঘোষ চিন্তা করলেন নতুন কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই দুধের ছানা দিয়ে পরীক্ষা করে মিষ্টির কাঠামো তৈরি করলেন। যার আকৃতি অন্য মিষ্টির চেয়ে বড় এবং অনেকটা কোল বালিশের মতো দেখতে। দু-একজনকে দেখালেন এবং খাওয়ালেন। মানুষ তখন মিষ্টির নাম জানতে চায়। নাম নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন তিনি। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করেও নাম ঠিক করতে পারলেন না। শেষে আকৃতির সঙ্গে মিল রেখে নাম দিলেন বালিশ মিষ্টি। আস্তে আস্তে গয়ানাথের বালিশ নামে পরিচিতি পেল ওই মিষ্টি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে মিষ্টিটি।
গয়ানাথ ঘোষ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ১৯৬৯ সালে ভারতে চলে যান। চলে যাওয়ার পর তার সহযোগী নিখিল চন্দ্র মোদক এই মিষ্টি তৈরির দায়িত্ব নেন। জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি বালিশ মিষ্টি তৈরির ধারা অব্যাহত রাখেন। নিখিল চন্দ্র মোদকের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে বাবুল চন্দ্র মোদক ও খোকন চন্দ্র মোদক এই মিষ্টির ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আজও তারা বালিশ মিষ্টি তৈরি করে অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। পুরোনো সেই ছোট্ট দোকান এখন অনেক বড় দোকান হয়েছে। মিষ্টি বিক্রি করে তাদের ব্যবসার প্রসারতা বেড়েছে। বারহাট্টা রোড ছাড়াও জেলা শহরের স্টেশন রোড ও মেছুয়া বাজারে আরো দুটি মিষ্টির দোকান দিয়েছেন।
বারহাট্টা রোডে রয়েছে বালিশ মিষ্টি তৈরির নিজস্ব কারখানা। ওই কারখানায় বালিশ মিষ্টির পাশাপাশি অন্যান্য মিষ্টিও তৈরি করা হয়। গয়ানাথের বালিশের সুনাম ও জনপ্রিয়তা দেখে জেলা শহরের অন্য দু-একটি মিষ্টির দোকানিও বালিশ তৈরি করে থাকে। তবে গয়ানাথের মতো তারা খ্যাতিলাভ করতে পারছেন না।
গয়ানাথের বালিশ এতটাই জনপ্রিয় যে প্রয়াত নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে এ সম্পর্কে বর্ণনা হয়েছে। এ ছাড়া কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখাতে তার নাম উঠেছে। স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকরা বালিশ মিষ্টিকে নিয়ে ছড়া-কবিতাও লিখে থাকেন।
মিষ্টির কারিগর রতন জানান, বালিশ মিষ্টি তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি ও ময়দা। প্রথমে দুধ থেকে তৈরি করা হয় ছানা, ছানা ও ময়দা দিয়ে মন্ড, আর মন্ড দিয়ে বানানো হয় বালিশ। সবশেষে চিনির রসে ভাজা হয় বালিশ। এ ছাড়া তৈরির সময় বালিশকে মুখরোচক করতে প্রয়োগ করা হয় বিশেষ কলাকৌশল। সেসব গোপন কথা জানাতে রাজি নন দোকান মালিক বাবুল চন্দ্র মোদক। পরিবেশনের আগে বালিশের ওপরে সুস্বাদু ঘন ক্ষীরের (দুধের মালাই) প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রথমে ছোট ও বড় দুই সাইজের বালিশ তৈরি করা হতো। দাম ছিল ১০ টাকা ও ২০ টাকা। ৫০ টাকা দামের মিষ্টি অর্ডার দিয়ে বানাতে হতো। এখন বিক্রি হয় ২০ টাকা ও ৫০ টাকা করে। প্রায় এক কেজি ওজনের একটি ২০০ টাকা এবং আধা কেজি ওজনের এক পিস মিষ্টি ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। যা বিশেষ করে অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গরমের সময় বালিশ তিন দিন এবং শীতের সময় সাত দিন পর্যন্ত এমনিতেই ভালো থাকে।
বাবুল চন্দ্র মোদক বলেন, ‘গাভির খাঁটি দুধ ছাড়া বালিশ বানানো হলে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। আমরা স্থানীয় ব্যাপারীদের কাছ থেকে দুধ কিনে থাকি। নেত্রকোনায় তিনটি দোকান ছাড়া আমাদের অন্য কোনো স্থানে শাখা নেই। সঠিক মান ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বালিশ তৈরির জন্য দুজন কারিগর নিয়মিত কাজ করেন। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক মানুষ আসে বালিশ নেওয়ার জন্য।’
রাইজিংবিডি/নেত্রকোনা/১৩ এপ্রিল ২০১৬/ইকবাল হাসান/মুশফিক/এএন
No comments:
Post a Comment