Sunday, 20 March 2016

Pine forest

পাইন বনে পথ হারিয়ে

ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:03 Mar 2016   12:21:55 AM   Thursday   
পাইন বনে পথ হারিয়ে
ফেরদৌস জামান : পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় ভ্রমণকালে পরিচয় হযেছিল অমিত রায় নামের এক পাখিপ্রেমীর সাথে। পেশায় অর্থনীতিবিদ। পূর্ব পুরুষের বাড়ি এপার বাংলায়। সুতরাং, আলাপ জমে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। আমাদের অবস্থান একই কটেজের পাশাপাশি ঘরে। শিলিগুড়ি থেকে আলগাড়াহ্ বাজার হয়ে বেলা শেষে উপস্থিত হই অত্র অঞ্চলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র রিসপে। বাহণের বিকল্প হিসেবে শেষের কয়েক কি.মি. পথ পায়ে হেঁটেই যেতে হয়। তাতে করে বেঁচে যায় এক থেকে দেড় হাজার রুপি। কটেজের কাছাকাছি গিয়ে পা যেন আর এগোতে চায় না।

দ্ইু দিনের ধকল শেষে অমন একটা অভ্যর্থনা ছিল সত্যিই দারুণ। কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব এক ভদ্র লোক। পা রাখতেই হাত বাড়িয়ে নিজের নাম উচ্চারণ করে হাসি মুখে স্বাগত জানিয়ে বললেন, অমিত, অমিত রায়।

বললাম, শেষের কবিতার অমিত?



গুরুগম্ভীর হেসে বললেন, না, শেষের কবিতার নয়, আপাতত পর্বত ঘেরা, মেঘে ঢাকা রিসপের অমিত। দেশে বিদেশে পাহাড়-পর্বত ঘুরে দেখা আর পাখির  ছবি তোলা তার নেশা। সেই ছবি দিয়ে প্রদর্শনী করা বা কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ- এসব নয়, ছবি তোলেন শুধুই শখের বসে। সময় পেলেই ছুট দেন কোনো না কোনো পাহাড়ি এলাকায়। সাথে থাকেন তার স্ত্রী জামিনী রায়। কথায় কথায় জানা যায় দক্ষিণ কলকাতায় নিজ বাড়ির অঙ্গিনায় গড়ে তুলেছেন বেশ বড় এক পাখির সংগ্রহশালা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা প্রজাতীর পাখি সংগ্রহ করে স্থান দিয়েছেন তার আপন বাড়ির আঙ্গিনায়। তার শখের এই বিষয়টি নেতিবাচকভাবে নিলে; স্বপক্ষে পাল্টা যুক্তি প্রদর্শন না করে নীরব থাকলেন তিনি। যা হোক, সে অন্য কথা। অরুণাচল, ত্রিপুরা, আসাম ও কাশ্মিরসহ দেশের বৈচিত্রময় বহু পাহাড়-পর্বতে তিনি ঘুরেছেন। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এসেছেন রিসপে। সেই সুবাদে আমাদের সাথে দেখা। আমাদের আগ্রহের ব্যাপারে জানতে পেরে পরামর্শ দেন, রিসপ-রিকিসুম পাইন ট্রেইল ট্রেকিং করার। দু’দিন পর তার কথা মত বেড়িয়ে পড়ি।



চারদিকে শুনশান নীরবতা, তার মাঝে সুউচ্চ পর্বতের ছয় হাজার ফুট উঁচু চূড়ার কোলে ছোট্ট বসতি রিসপ। মেঘে ঢাকা শান্ত ¯িœগ্ধ রিসপ যেন এক স্বপ্নপুরী। সকালের রোদ সবে ফুটে বেড়িয়েছে, আশপাশের গেস্টহাউজ ও কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ পর্যটকগণ। উপভোগ করছেন মেঘ আর রোদের অপরূপ খেলা। হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি, প্রত্যেকেরই প্রধান পেশা পর্যটন সম্পর্কীয় ব্যবসা। পর্যটকের সংখ্যা উপচে পড়া নয়, একেবারেই সীমিত। পশ্চিমবঙ্গের নিরিবিলি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে এটি একটি। দুদিন অবস্থানেই বুঝতে পাই প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে একেবারেই বাছাই করা কিছু মানুষ সেখানে গিয়ে থাকে। একজনের সাথে তো আলাপ করে জানতে পাই, মাস-দুই হয় তিনি পরে রয়েছেন। অথচ, তার পরিকল্পনা ছিল নাকি মাত্র এক সপ্তাহ থাকা।



মাঝে মাঝে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও একবার করে এসে দেখা করে গিয়েছে, ভদ্রলোক নড়বার নয়। হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে প্রবেশ করি লাডাম নামে দূরের এক বসতিতে। প্রত্যন্ত গ্রাম অথচ, তাদের রুচি ও সৌখিনতার প্রশংসা করতে হয়। কাঠের তৈরি বাড়িগুলোতে টবে সাজানো নানা প্রজাতীর ফুল গাছ। ফুটে রয়েছে রঙ-বেরঙের মৌসুমী ফুল। বসতির মাঝ দিয়ে চলছি, এক পর্যায়ে পানির তেষ্টা পেলে বোতল বের করতে পিঠের ব্যাগ না নামিয়ে কোনো একটি বাড়ি থেকেই পান করার ইচ্ছা করি। পানি পান করার পর আবারও হাঁটা শুরু করলাম সামনের দিকে। আমরা তখনও জানি না ভুল পথে আছি। তুলনামূলক সমতল পথ পেয়ে মজায় মজায় হাঁটছি। পেরিয়ে গেছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। পথিমধ্যে আগ্রহ করে এগিয়ে আসেন স্থানীয় এক বৃদ্ধ, জানতে চান কোথায় যাচ্ছি। উত্তর শুনে বলেন, উল্টো পথে এসেছেন; এদিকে এগুতে থাকলে রিকিসুম যাওয়ার পাইন ট্রেইল নয়, জঙ্গল পথে পৌঁছে যাবেন সোজা সিকিম। সিকিম! আমরা জানি বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীদের জন্য সেখানে প্রবেষাধিকার সংরক্ষিত। বেঁচে গেলাম! লোকটাকে না পেলে হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই ঢুকে যেতাম সিকিম। তাতে করে নিশ্চিত কোনো বিপদে পড়তে হতো।



এতক্ষণ ভুল পথে হাঁটলেও মনের মধ্যে কষ্ট অনুভূত হলো না বরং সেই অভিজ্ঞতার রোমাঞ্চকর অনুভূতি ঘিরে ধরল। পথে যদি লোকটিকে না পেতাম তাহলে তো অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা সিকিমের ভেতর! তারপর কী হতো? কেমন হতো? এমন সব ইত্যাদি কল্পনার গল্প করতে করতে সঠিক পথে হাঁটতে থাকলাম। পাথর ভেঙ্গে টুকরো করে বিছানো পথ, ময়লা আবর্জনা নেই। শহর বন্দর থেকে বহু দূরে পার্বত্য অঞ্চলের নীরবতায় পাশাপাশি মাত্র কয়েকটি বসতি; সেখানেই গড়ে উঠেছে চমৎকার এক পর্যটন কেন্দ্র। সকালে উঠে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যায়, বড়রা জঙ্গল থেকে খড়ি-লাকড়ি সংগ্রহ অথবা অতিথিদের জন্য দূরে কোথাও বাজার-সদাই করতে যায়। পথে চলছে দু’একটি ছাদ খোলা বলেরো জিপ। সবুজ ঘেরা সরু পথ থেকে ক্রমেই প্রবেশ করি কাক্সিক্ষত পাইন ফরেস্ট ট্রেইলে।



ভেবেছিলাম অনেক মানুষের দেখা পেয়ে যাব কিন্তু না, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষ বলতে কেবল আমরাই তিন জন। বহু পুরনো পাইন গাছগুলোর নিচ দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়েছে ট্রেইল। এক ঘণ্টার মতো হাঁটার পর সত্যি সত্যিই যখন কোনো মানুষের অস্তিত্ব চোখে পড়ল না তখন এক ধরনের শীতল ভীতি এসে জায়গা করে নিল মনের ভেতর। এর মধ্যে বনও গভীর হতে শুরু করেছে। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মাঝেমধ্যে দু’একটা পাখির কুজন অমন পরিবেশে যথেষ্ট সাহস যুগিয়েছে। তার মধ্যে মনে পড়ে গেল অমি’দার কথাগুলি- নানা প্রজাতীর পাখির পাশাপাশি হরিণ ও বানরও রয়েছে। ক’বছর আগে নাকি বাঘও দেখা গিয়েছে। আমরা যদিও পাখি ছাড়া অন্য কিছুই পেলাম না তবে যত্রতত্র হরিণের বিষ্ঠা পরে থাকতে দেখলাম। কি আর করা! হরিণ দেখার সাধ বিষ্ঠাতেই সারতে হয়েছে। বনের শেষে পরোবর্র্তী বসতিতে গিয়ে যা জানতে পাই; তা আগে জানা থাকলে বোধহয় ও পথে ট্রেকিং করার সাহসই করতাম না- শুধু হরিণ, বানর আর বাঘই নয় বনে নাকি ভাল্লকও রয়েছে!



বিকেল নাগাদ পেয়ে যাই রিকিসুম নামক বসতির নাগাল। চার-পাঁচটি বাড়ি নিয়ে ছোট্ট বসতি। পর্বতের খাঁজের ঘরগুলো ভীষণ পরিপাটি। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে একটি করে অতিরিক্ত ঘর, পর্যটকরা চাইলে যেখানে থাকতে পারে। থাকবার এই ব্যবস্থাটি স্থানীয়ভাবে ‘হোম-স্টে’ বলে পরিচিত। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল সুস্মিতাদের বাড়িতে। তার মা খুব ভালো মাখন তৈরি করতে পারেন। এই সুবাদে দেখা হলো সনাতন পদ্ধতিতে কীভাবে মাখন প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। পরিবারটির সাথে বেশ আন্তরিক এক সময় কাটল। মাঝে সুস্মিতার ভাবির সাথে গেলাম পূজা পাঠ দেখতে। সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতির পূজা পাঠ। আমরা জানি পুরহিতরা সাধারণত বয়োস্ক হয়ে থাকে কিন্তু এখানকার পুরোহিত মহাশয় বয়সে একেবারে টগবগে যুবক। পূজা শেষে আলাপ পরিচয়ের পর তিনি এক নতুন গন্তব্যের ব্যাপারে অবহিত করেন।



বসতির উত্তর পাহাড়টার চূড়ায় রয়েছে ব্রিটিশ আমলের এক বিশেষ স্থাপনা। পুরোহিত মহাশয়ের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরের দিন সকালে দেড় ঘণ্টা ট্রেকিং করে উপস্থিত হই সেখানে। অর্ধগোলাকৃতির স্থাপনাটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই তবে ভিত্তিমূল অটুট রয়েছে এখনও। সাহেবরা নাকি অবসর কাটানো ও শিকার করার উদ্দেশ্যে জায়গাটি নির্মাণ করেছিলেন। পর্বতের সবুজ ধোয়া নির্মল বাতাস এখানকার নিত্য সঙ্গী। সম্মুখে দিগন্তের ওপারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পর্বত চূড়া। তারই শরীর ধরে এগিয়েছে চিকন রশির মত পথ। পথের পাশে দুটি একটি হঠাৎ বসতি। অরণ্যের মাঝে মিষ্টি রোদে চিক চিক করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দূরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বসতি। আবার ক্ষণেক বাদেই হারিয়ে যায় দুরন্ত মেঘের উচ্ছ্বলতায়। সমস্তটা দিন কাটে গেল পর্বত চূড়ার ভাঙ্গা স্থাপনায়। অবশেষে পাইন ঘেরা অতি পুরনো অথচ চমৎকার পথটি ধরে সন্ধার আগেই ফিরে আসি রিকিসুম।

http://www.risingbd.com/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%A5-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87/150048


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ মার্চ ২০১৬/তারা

No comments:

Post a Comment