পদ্মা পেরিয়ে টুঙ্গিপাড়ায়
ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:24 Mar 2016 09:11:24 PM Thursday || Updated:25 Mar 2016 08:36:11 AM Friday

স্নেহতুল্য বন্ধু সাফিন ফোন করে আগেই বলে, যা বলতে যাচ্ছি তাতে কোনো দ্বিমত করা চলবে না। ভোর সাড়ে ছয়টায় ঢাকা হাতিরপুল থেকে রওয়ানা করা হবে, সময় মত উপস্থিত থাকা চাই।
আমরা জানি টুঙ্গিপাড়া একটি ঐতিহাসিক জায়গা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। এবং তিনি সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। এতদিন ঢাকায় থাকা হয় অথচ সেই জায়গাটিতে যাওয়া হয়েই ওঠেনি। সুতরাং, প্রমত্তা পদ্মা, ধুধু বালুচর ইত্যাদি মিলিয়ে পরের দিনের ভ্রমণ কীভাবে উপভোগ্য করে তোলা যায় এ নিয়ে নানা ভাবনা। ভাবনায় রাতটা নির্ঘুমই কেটে গেল।
দিনটি ছিল ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। আমার নিবাস রাজধানীর মিরপুর শ্যাওড়াপাড়া থেকে হাতিরপুল পৌঁছতে বিশ মিনিটের মত বিলম্ব হয়ে গেল। যে কারণে বকুনির অন্ত রইল না। দায়টা মেনে নিয়ে চোখ কান বন্ধ রেখে সব হজম করতে হল। সফরসঙ্গি আমিসহ সাতজন। সফিন, কামরুজ্জামান, আরমান, সুমন, মোশাররফ ও তার স্ত্রী। বাহন হিসেবে ছিল মোশাররফের হাইস মাইক্রোবাসটি।
সকাল নয়টার মধ্যে পৌঁছে যাই মাওয়া ঘাটে। আগের রাত থেকে ফেরির প্রতীক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে শতশত যানবাহন। নির্দিষ্ট লাইনে আমরাও জায়গা করে নিলাম। জানতে পাই ঘন কুয়াশার কারণে রাত এগারটার পর থেকে মাওয়া-কাওড়াকান্দী রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। কখন আবার চালু হবে তা সম্পূর্ণই ওই কুয়াশা কেটে যাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং সকালের নাস্তা করার একটা ভালো সুযোগ বটে। প্রতিটি রেস্তোরাঁর সামনে একজন করে লোক দাঁড়ানো, খরিদ্দার আকর্ষণে উচ্চ শব্দে; ছন্দ আর তালে তালে আহ্বান করে যাচ্ছে। ক্ষুধা কম বেশি সবারই পেয়েছে। মনে আছে, যমুনা সেতু হওয়ার আগে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা আসতে পাবনা নগরবাড়ি-আরিচা (মানিকগঞ্জ) ঘাট হয়ে আসতে হত। বাবা-মার সঙ্গে ঢাকা আসার পথে ঘাটের কোনো রেস্তোরাঁয় কিছু খেতে চাইলে নিরুৎসাহিত করে বলতেন ব্যাগে যা আছে তাতেই চালিয়ে নিতে হবে। মেলাতে পারতাম না, কেবলমাত্র এইঘাটে এসেই বাবা-মা এমন কৃপন বনে যান কেন! কয়েক বছর পর পত্রিকায় একটি ভয়ানক সংবাদ দেখে বুঝতে পাই বাবা-মার সম্বন্ধে সেদিনগুলির ধারণা ছিল ভুল। নগরবাড়ি ঘাটের এক খাবারের দোকানের রান্না ঘর থেকে শিয়ালের মাংস উদ্ধার হয়েছে। খাসির মাংস বলে যা দেদারসে চালিয়ে আসছে। উত্তম মাধ্যম দেওয়ার পর স্বীকার করেছে, অনেকদিন ধরেই কারবারটি চলমান। আমার এই অভিজ্ঞতার কথা শোনার পর আর কোথায় যাই! মোশাররফের স্ত্রীকে তো নাস্তা করার জন্য রেস্তোরাঁয় ঢোকাতে যারপর নাই বেগ পোহাতে হল।
দীর্ঘ তিন ঘণ্টা পর বারটায় খবর এলো ওপার থেকে এক সঙ্গে কয়েকটি ফেরি ছেড়ে দিয়েছে। অবশেষে বেলা দেড়টায় ফেরিতে আরোহণ করতে সক্ষম হই। অধিকাংশ ফেরিই সেকেলে। চলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। পেট বরাবর থেকে খানিক পেছনে অন্য একটি ইঞ্জিন-ফেরি রশি দিয়ে বেঁধে দেওয়া, মূলত তার চাপেই মূল ফেরিটি এগিয়ে চলে। অর্থাৎ ঠেলে পার করা হয়। স্থানীয়ভাবে সেগুলি ‘ঠেলা ফেরি’ বলে পরিচিত। দশ-বারটি করে গাড়ি নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে কাওড়াকান্দীর উদ্দেশ্যে। দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। সে কর্মযজ্ঞে ঘাটসহ আশপাশের দুইদশ মাইল এলাকা জুড়ে এক জমজমাট পরিবেশ। মাওয়া-কাওড়াকান্দী রুটে চলাচল করা দক্ষিণ বঙ্গের নিয়মিত যাত্রীদের চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের চিহ্ন। বিড়ম্বনার দিন শেষ হতে চলেছে।
সমস্ত পথটাই ইঞ্জিন-ফেরিটির ছাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেলাম। কথায় কথায় পরিচয় হয় এক চাকরিজীবীর সঙ্গে। চাকরি সূত্রে স্বপরিবারে ঢাকায় থাকেন সেই নব্বই সাল থেকে। শখ ও সামর্থ দুই-ই ছিল একটি ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার। বাঁধা কেবল পদ্মানদী। এবার সেই শখ পূর্ণ হতে চলেছে।
এগিয়ে যেতে যেতে এক ঘণ্টার মধ্যে প্রবেশ করি এক চওড়া খালের মাঝে। দুইপাশের চরে মৃদু বাতাসে দুলছে লকলকে ধানের ডগা। গড়ে উঠেছে অনেক বসতি। বিভিন্ন গাছগাছালির মাঝে টিনের চালার ঘরগুলি যেন একেকটি স্বপ্ননিবাস। ফসলের ক্ষেত, নদীর মাছ, হু হু বাতাস, উঠোন জুড়ে কবুতর ঝাকের বাকবাকুম ডাক। কী সহজ সরল জীবন তাদের! গরু-ছাগল চড়ানো, নদীর জলে দুরন্ত সাঁতার আর সাঁঝের বেলায় কুপির আলোয় পডতে বসা, এমন কিশোর জীবনের স্বাধ ক’জনেরই বা মেলে। যা ঐ চরের জীবনে নিত্তদিনের ব্যাপার। এক সময় শুকনো মৌসুমেও পদ্মার বুকে খেলে যেত দিগন্ত জোড়া জলরাশি আর বর্ষার কথা তো বলাই বাহুল্য। অথচ, সেই প্রমত্তা নদীর বুক জুড়ে চোখে পড়ে কেবল খাল-খাড়ি। তারই মাঝে দিয়ে বয়ে চলে লঞ্চ, ফেরি, নৌকা ইত্যাদি। সোয়া দুই ঘণ্টায় পৌঁছে যাই কাওড়াকান্দী।
ফাঁকা পথ। গাড়ির সংখ্যা খুবই নগন্য। সবুজে ঢাকা শ্যামল-কালো পথ। এগিয়েছে ধুধু পাথরের মাঝদিয়ে। গোপালগঞ্জ পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বেজে যায় সাড়ে সাতটা। নিয়ম অনুযায়ি বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত সমাধি প্রেমিসেজ। দায়িত্বপ্রাপ্তদেরকে যখন বুঝানো সম্ভব হল যে, জায়গাটি দেখে আজই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতে হবে। তবে যে আমাদেরকে প্রবেশ করতে দেওয়া হল। স্থাপনা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটি অনন্য বটে। তোরণ পেরিয়ে লাল ইট বিছানো পথ।দুইপাশে সবুজের প্রাধান্য। বৈদ্যুতিক আলোয় অসাধারণ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।
নির্মাণশৈলী দেখে আন্দাজ করা যায় যে, এ এলাকা ঘিরে প্রকৃতির রূপটিকেই অটুট রাখা হয়েছে। পুরনো একটি বৃক্ষও কেটে বাদ দেওয়া হয়নি। সামান্য সংস্কার ছাড়া কাটা পুকুরটি তেমনই রাখা হয়েছে। মাজার প্রাঙ্গণে গিয়ে বুঝানোর পর ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া হল। শর্ত জুড়ে দেওয়া হল কোনো ছবি তোলা যাবে না।
খাদেম নূর ইসলাম ঘুরে দেখালেন মাজারের ভেতরটা। মাজার থেকে বেরিয়ে আশপাশটা দেখার পর প্রেমিসেজের বাইরে; পূর্ব পাশে বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান। বৃক্ষ ঢাকা দোকানগুলির মাঝে একটিতে বসে চা পান শেষে বের হয়ে আসার পথ ধরি।
বন্ধুদের কারোরই মন যেনো ভরল না। রাত্রি হয়ে যাওয়ায় সম্পূর্ণ স্থাপনাটি ভালোভাবে ঘুরে দেখা হল না! অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালা ও পাঠাগার দেখা বাকিই রয়ে গেল। এখানে আর তেমন অনুনয় বিনয় করার প্রয়োজন পড়ল না। দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকটি আমাদের মনের অতৃপ্ত বাসনার কথা বুঝতে পেরে নিজ থেকেই দরজা খুলে জ্বালিয়ে দিলেন সমস্ত বাতি। নিচতলার ছোট্ট পাঠাগারটি আন্তর্জাতিক মানের। সাজানো রয়েছে অনেক দেশি-বিদেশি বই। পাঠক চাইলে শান্ত সুনিবিড় পরিবেশে বসে পড়তে পারে যে কোনো বই। ওপর তলায় সংগ্রহশালার অন্যতম আকর্ষণ পচাত্তরের পনেরই আগস্ট স্বপরিবারে নির্মমভাবে নিহত শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ বহন করা কফিন। পাশেই আর একটি কাঁচের বাক্সে সাজানো রয়েছে তাঁর পিতার কফিন। সংগ্রহশালা থেকে বের হলে তার পাশেই গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর আদলে গড়া উন্মুক্ত মঞ্চ। নিকটেই পশ্চিম পাশে দৃষ্টিনন্দন ছোট একটি মসজিদ। বিশেষ নিরাপত্তা ব্যাবস্থায় ঢাকা থাকে সম্পূর্ণ এলাকা।
এবার বিদায়ের পালা। টুঙ্গিপাড়া সদরের এক পরিপাটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে একই পথে রওয়ানা করা হয় ঢাকার উদ্দেশে। ওদিকে সবার মাথায় একই চিন্তা, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল যদি আবারও বন্ধ হয়ে না যায়। যাহোক, এ যাত্রায় রক্ষা। ঘাটে এসেই মিলে যায় ফেরি। মনে হয় যেনো আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মার্চ ২০১৬/সাইফ
No comments:
Post a Comment