Sunday, 10 January 2016

A small small Island

A piece of Island 

ছেঁড়াদ্বীপে নায়িকা মৌসুমী পাথর

ফেরদৌস জামান : রাইজিংবিডি ডট কম
Published:10 Jan 2016   02:09:38 PM   Sunday   
ছেঁড়াদ্বীপে নায়িকা মৌসুমী পাথর
ফেরদৌস জামান : পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে এ দেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় হলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণে আসা সৌখিন পর্যটকদের একাংশ জীবনে একবার হলেও এখানে বেড়াতে আসেন। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত দেখতে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অনেকেই আবার প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন না দেখে ফিরতে চান না। মৌসুমে দৈনিক কয়েক হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে ভিড় জমান। পর্যটনবান্ধব সার্বিক ব্যবস্থাপনা না থাকলেও প্রকৃতিপ্রেমীরা এক অদৃশ্য টানে ছুটে যান ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ খ্যাত এই দ্বীপটিতে। অনেক দিন আগের কথা, ব্যাঙ্গালোর নিবাসী কলকাতার সুপ্রিয়দা ও তার স্ত্রী পাম্পিদি তাদের বড়িতে নিমন্ত্রণে গেলে গভীর আগ্রহে সেন্টমার্টিন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। না দেখার কারণে সেদিন আমি তাদের কিছুই শোনাতে পারিনি। তাতে তারা ভীষণ আশাহত হয়েছিলেন। সেদিন তাদেরকে বলেছিলাম, আসছে মৌসুমে তোমরাও বাংলাদেশে চলো, সকলে মিলেই সেন্টমার্টিন যাব। সেদিনই তৈরি করে ফেলা হয় পূর্ণাঙ্গ একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা। ঐ পর্যন্তই, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। কে জানে হয়ত সুপ্রিয়দা ও পাম্পিদি আসেনি বলেই আমার সেন্টমার্টিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

যাই হোক, অবশেষে প্রায় নয় বছর পর যাওয়ার সুযোগ হলো সেখানে। তবে দাদা-দিদির সাথে নয়, আমার অনেকগুলো ভ্রমণের সঙ্গী  ফয়সাল ভাইয়ের সাথে। প্রথম রাতটা থাকা হয় ইনানী সৈকতের এক রিসোর্টে। ভ্রমণ তালিকা থেকে ইচ্ছা করেই কলাতলী বা লাবনী পয়েন্টের মত সৈকতগুলো বাদ রেখে দেই, কারণ সেখানকার পরিবেশ আমার এতটাই খারাপ লঅগে যে মনে হয় কক্সবাজার নয়, যেন গুলিস্থানে আছি। কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ ধরে সড়কটি এগিয়েছে সৈকতের একেবারেই কাছ দিয়ে। বাম পাশে পাহাড়শ্রেণী আর ডান পাশে সৈকত, তার মাঝ দিয়ে ছুটে চলছে গাড়ি। এমন অপরূপ ব্যঞ্জনা কেবল কক্সবাজারেই মেলে। হোটেল লা-বেলার বিলাসবহুল ঘরটায় খানিকক্ষণ বিশ্রাম করেই বেড়িয়ে পড়ি সৈকতের টানে। সৈকত ধরে দীর্ঘ একটা হাঁটা দেয়ার পর নেমে পড়ি সমুদ্রের জলে। দুপুরের পর পরই উঠে আসতে হয়, কারণ খেয়েদেয়ে বিশ্রামের পর একেবারে পূর্ণ মেজাজে সূর্যাস্তটা উপভোগ করতে চাই।



পরের দিন রওনা দেই টেকনাফ লঞ্চ ঘাটের উদ্দেশে। পথ প্রবেশ করে সুনসান এক পাথারের মাঝে, পাশে ঠিক সেই পাহাড়শ্রেণী যা মেরিন ড্রাইভের পাশ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানা যায়, এই রেঞ্জ উত্তরে চলতে চলতে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চলের উপর দিয়ে নানা নামে নানা পরিচয়ে হিমালয় পর্বতমালার সাথে সংযুক্ত। লঞ্চের টিকিট তাদের ঢাকা কার্যালয় থেকেই সংগ্রহ করা ছিল। পৌঁছেই দেখি জেটিতে নোঙর করা এলসিটি কুতুবদিয়া। তিন তলা লঞ্চ। নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে উপবেশনের অল্প পরই লঞ্চ ছেড়ে দেয়। নাফ নদীর মোহনায় পৌঁছার পর থেকেই লঞ্চ সামনে-পেছনে হালকা দুলতে থাকে। কৌতূহল হওয়ায় কর্তৃপক্ষের একজনের নিকট জানতে চাইলে অভয় দিয়ে বললেন, এই এলাকায় আসার পর তলানীতে পানির ধাক্কায় এমন হয়। ক্রমেই পানির রং পরিবর্তিত হয়ে নীল হয়ে গেল। পেছনের দিকে তাকালে ছেড়ে আসা দেশের মূল ভূ-খণ্ডের রেশটা আবছা চোখে পড়ে। সাদা ও ছাই রঙের মিশেলে সামুদ্রীক চিল (সীগাল) এমনভাবে নিকট দিয়ে উড়ে যায়, যেন এক্ষুণি এসে শরীরে বসবে। মনে হয় যেন হাতটা সামান্য বাড়িয়ে ধরলেই ছোঁয়া যাবে। ওরা এমন করে লঞ্চের পাশাপাশি চলতে থাকে একেবারে শেষ অবধি।



নীল জল কেটে এগিয়ে চলছে কুতুবদিয়া। আশপাশে মাছ ধরায় ব্যস্ত ছোট ছোট নৌকা। সমস্ত পথের পূর্ব পাশজুড়ে মিয়ানমারের কালচে রঙের পর্বতশ্রেণী। কোথাও কোথাও আবার সৈকতের পর থেকেই কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। এবার সবকিছু ছাড়িয়ে দৃষ্টি সীমায় ধরা দেয় নারিকেল জিঞ্জিরার সবুজ মাস্তুল। লঞ্চ গিয়ে ভিড়ল জেটিতে। অবতরণের পর রেলিং দেয়া সরু সেতু ধরে এগিয়ে গেলেই দ্বীপের মূল ভূ-খণ্ড। তা স্পর্শ করার আগেই মনটা ভারি হয়ে যায় বৃহৎ আকারের একটি কচ্ছপের মৃত দেহ দেখে। সৈকতের স্যাঁতসেঁতে বালুকাবেলায় মরে আধপঁচা হয়ে পড়ে রয়েছে। এত বড় কচ্ছপ এর আগে কখনও দেখিনি। মনে আছে কচ্ছপটি দেখার জন্য রিসোর্টে সব রেখে আবার ফিরে এসেছিলাম। তখন অবশ্য ওর সৎকার চলছিল। রিসোর্টটার নাম ঠিক মনে নেই, তবে তা ছিল দ্বীপের একেবারেই দক্ষিণ পাশে। সেখানে ঢুকেই কঁচি ডাবের পানি পান করার সুয়োগ মিলল। ম্যানেজারই সব ব্যবস্থা করেছে। আমরা ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানালাম। মনটাও ভালো হয়ে গেল। কিন্তু সম্পূর্ণ দ্বীপটা এক চক্কর ঘুরে দেখার পর অভিজ্ঞতা যা হলো তা ভীষণ বাজে! দুই কথায় বর্ণনা করলে বলতে হয়, ভীষণ অগোছালো এবং সু-ব্যবস্থাপনা বলতে যা বোঝায় তা সেখানে একেবারেই নেই। দ্বীপটির অস্তিত্ব নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে শংকা প্রকাশিত হয়ে আসছে তা শতভাগ খাঁটি। যাই হোক, সে বিষয়ে পরবর্তীতে কখনও হয়ত লেখা যাবে।



রিসোর্টের অবস্থান দ্বীপের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে হওয়ায় সূর্যাস্তের সময়টা ছিল বেশ নিরিবিলি। সৈকতের কাছাকাছি রয়েছে বিসোর্টের কাঠের তৈরি ডাইনিং। ঠিক তার ওপর তলায় উঁচু ছাউনির নিচে চারপাশ খোলা বসার জায়গা। এক মগ ব্ল্যাক কফির সাথে সূর্যাস্তের মুহূর্তটা ছিল অসাধারণ! এরপর পা বাড়াই দ্বীপের একমাত্র বাজারের দিকে। সর্বপ্রথম চোখে পড়ে নানা প্রজাতীর মাছ নিয়ে বসে থাকা বিক্রেতাদের। টেবিলে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা রূপচাঁদা, সুরমাচাঁদা, কোরালসহ প্রভৃতি মাছ ও লবস্টার এবং বিভিন্ন প্রকার মশলাদীর বোতল ও কৌটা। নিকটে গিয়ে দাঁড়াতেই বিক্রেতা বর্ণনা করেন প্রতিটি প্যাকেজের মূল্য। পাঁচশ থেকে হাজার বারশ টাকায় সেখানেই বারবিকিউ বা গ্রীল আকারে প্রস্তুত করে দেয়া হচ্ছে পছন্দের মাছ। একটি মাছ কিনলে দুই-তিন জন অনায়াসেই খেয়ে নেয়া যায়। আমরা অবশ্য তাদের খরিদ্দার হতে পারিনি কারণ আমাদের মৎস্য ভোজনের বিশেষ আয়োজন রিসোর্টেই ছিল। রাত যত গভীর হতে থাকল সমুদ্রের গর্জন ততটাই কাছাকাছি হতে লাগল। জানালা ফাঁক করলেই জ্যোৎস্না রাতের সৈকতে এসে একেকটি ঢেউয়ের আছড়ে পরার দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেই পরিবেশে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকাটা বিশেষ কিছু কাজের কথা নয়। মাঝে ব্যাবধান শুধু বাঁশের তৈরি অনুচ্চ প্রাচীর। গভীর রাত, সদর দরজা বন্ধ, তাতে কি? নিয়ম এবং প্রাচীর দুটোকেই তুচ্ছ মনে হলো। প্রাচীর টপকে বেরিয়ে পরি। ঢেউয়ের ও পারের দিগন্ত সম্মুখে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ছোট্ট মাচানটা ছিল বসার জন্য ভীষণ উপযোগী। অদূরেই মাছ ধরা ট্রলারগুলো আবছা দেখা গেল। খানিক বাদেই ট্রলার থেকে ছোট নৌকা করে বয়ে আনা হলো কয়েক ঝাকি মাছ। চাঁদের আলোয় ঝকঝকে টাটকা মাছ দেখে মনটা ভরে উঠল।



আমাদের এই ভ্রমণের প্রধান লক্ষ ছিল ছেঁড়াদ্বীপ থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করা। যার জন্য সেন্টমার্টিন থেকে পায়ে হেঁটেই সেখানে যাওয়ার কথা। বাধা হয়ে দাঁড়াল জোয়ার-ভাটার তারতম্য বুঝে উঠতে না পারার বিষয়টি। সুতরাং সে ঝুঁকি না নিয়ে অন্য একটি দলের সাথে নৌকায় করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। প্রায় এক ঘণ্টার নৌ-ভ্রমণের পর এবার ছেঁড়াদ্বীপে পা রাখার পালা। সে লক্ষে দ্বিতীয় দফায় আরোহণ করতে হলো একটি ছোট্ট নৌকায়। ঢেউয়ের ধাক্কায় তাতে টেকাই কঠিন! প্রতি খ্যাপে ৫-৬ জন করে পার করা হলো। ধারালো পাথরে পা রাখা বেশ কষ্টকর, আবার বিপজ্জনকও। সামান্য এদিক সেদিক হলেই ছিলে বা আঁচড়ে যেতে পারে। সূর্যাস্তের কিছুটা সময় বাকি। এই ফাঁকে নৌকা চালকের ১৩-১৪ বছরের সহকারী রাসেলকে নিয়ে আশপাশটা ঘুরে দেখি। ছেলেটির বড় ইচ্ছা, আমাকে একবার ‘মৌসুমী’ পাথরে চড়ায়। এমন নামের হেতু জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে উল্টো জানতে চায়- ‘আপনারা না ঢাকায় থাকেন? সিনেমার গানে নায়িকা মৌসুমীর সেই গানটা দেখেননি, সিনেমায় এই পাথরে উঠেই তো সে নেচেছিল!’

ভিজে যাওয়ার ভয়ে শেষাবধি তার ইচ্ছাটা অবশ্য পূরণ করতে পারিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এলো আমাদের ইচ্ছাপূরণের মুহূর্ত। প্রতিক্ষিত সূর্যাস্ত শুরু হলো। লাল টকটকে সূর্য ধীরে ধীরে সমুদ্রের বুকের মধ্যে ডুব দিল। উন্নত ক্যামেরা না থাকায় মূহুর্তটা মনের মত করে ধরে না রাখতে পারার কষ্ট কিছুটা ছিল বৈকি। পরোক্ষণেই ভেবেছি তা যাদি মনের মধ্যে থেকে থাকে তাহলে এর চেয়ে সুখের আর কি হতে পারে? সেদিন কে জানত যে, ভ্রমণবৃত্তান্ত একদিন ভ্রমণ কাহিনী হয়ে পত্রিকায় যাবে? পত্রিকায় ভ্রমণ কাহিনী লিখতে ছবি যে একটি মূল্যবান বিষয় তা জানা থাকলে হয়ত ধার করে হলেও একটা ক্যামেরা নিয়ে যেতাম।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জানুয়ারি ২০১৬/তারা

No comments:

Post a Comment